রাঢ় বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে ঘুরে নতুন প্রজাতির প্রাণীর খোঁজ করা গত দশ বছরের পুরোনো রুটিন কেশপুর কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুমন প্রতিহারের। বিশেষ করে জুন থেকে অগস্টের ভরা বর্ষার সময়টাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ তাঁর। ঝাড়গ্রাম জেলার নয়াগ্রাম অঞ্চলের জংলা এলাকায় পুরোনো অভ্যেসের টানেই একদল ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ফিল্ডওয়ার্কে গিয়েছিলেন তিনি।
সেই সময়েই তাঁর নজর পড়ে ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত লাল লাল ছোপ দেওয়া অতি ক্ষুদ্র ব্যাঙটার উপরে। একটা নয়, বেশ কয়েকটা। বর্ষার ভেজা মাটিতে গাছের তলায় লাফালাফি করছে। প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপকের অভিজ্ঞ চোখ প্রথম দর্শনে বুঝে উঠতে পারেনি ব্যাঙের প্রজাতি। নিছক কৌতূহলেই কয়েকটা নমুনা সংগ্রহ করে নেন গবেষণাগারে ভালো করে দেখার জন্য।
কেশপুর কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপকের ওই কৌতূহল বাংলার তো বটেই, ভারতের জীববৈচিত্র্যের দুনিয়ায় মাইলফলক হয়ে রইল। নয়াগ্রামের জঙ্গল থেকে তুলে নেওয়া ব্যাঙের ওই প্রজাতি (মাইক্রোহাইলা তরাইয়েনসিস) পৃথিবীতে ক্ষুদ্রতমগুলির অন্যতম। এত দিন ভারতে এই মাইক্রোহাইলা পরিবারের অন্য কয়েকটি প্রজাতির ব্যাঙের দেখা মিললেও এমন ক্ষুদ্র প্রজাতিটি ভারতে নেই বলেই মনে করা হতো।
সুমন প্রতিহার বলছেন, ‘এই প্রজাতির ব্যাঙ দৈর্ঘ গড়ে মাত্র ১৫ মিলিমিটার। এশিয়ার ক্ষুদ্রতম মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে এটি অন্যতম। কলেজের গবেষণাগারে মাইক্রোস্কোপের তলায় ব্যাঙের নমুনাটি ফেলে কাজ করতে গিয়ে দেখি এর জন্য আরও শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন। আমি তখন জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (জ়েডএসআই) অ্যাম্ফিবিয়ান সেকশনের গবেষক কৌশিক দেউটির সঙ্গে যোগাযোগ করি।’
জ়েডএসআইয়ের গবেষক কৌশিক দেউটি বলছেন, ‘ভারতের ভূখণ্ডে এখনও পর্যন্ত ৪১৩ প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেই তালিকায় আরও একটি নাম যোগ হলো। এটা প্রাণীবিজ্ঞানীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো পশ্চিম মেদিনীপুর সংলগ্ন এলাকায় এর খোঁজ পাওয়া।’ এই আবিষ্কারের কথা এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
জীববৈচিত্র্যর হট-স্পট বলতে মানুষের মনে প্রথমেই আসে হিমালয় এবং পশ্চিমঘাটের পার্বত্য অঞ্চলের কথা। কিন্তু আপাত-শুষ্ক রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত এলাকাও যে জীববৈচিত্র্যর জন্য অত্যন্ত আকর্ষক হতে পারে, মাইক্রোহাইলা তরাইয়েনসিসের সন্ধান আরও একবার সেটা বুঝিয়ে দিল। অতীতে এই অঞ্চল থেকেই মাকড়সা ও ব্যাঙের অন্য প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল।
জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় এই আবিষ্কার নিয়ে উচ্ছ্বসিত— ‘প্রাণীবিদ্যায় ফিল্ড ওয়ার্কের কোনও বিকল্প নেই। আমাদের কাজ নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে প্রাণীবিদ্যাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই আবিষ্কার আগামী দিনের গবেষকদের উৎসাহ দেবে।’