এক বিচারপতিকে ‘ইম্পিচ’ করা উচিত বলে আর এক বিচারপতি মন্তব্য করছেন, রাজনৈতিক স্বার্থের অভিযোগে বিদ্ধ করছেন–এমনটা ভারতের ইতিহাসেই অভূতপূর্ব। প্রেক্ষিত বুধবারের সেই মামলাই। ডাক্তারির ভর্তিতে ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্রের অভিযোগের সেই মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য না-শুনে একপেশে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অভিযোগে পরক্ষণেই ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল।
মৌখিক ভাবেই স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চ। কিন্তু মৌখিক স্থগিতাদেশে আমল না-দিয়ে সিবিআই নির্দেশ বহাল রেখে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে এফআইআর রুজুর নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বিকেলে ফের রাজ্য দ্বারস্থ হয় ডিভিশন বেঞ্চের। সব শুনে সিবিআই তদন্ত স্থগিতে লিখিত নির্দেশই দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। কথায় কথায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশদান নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল ওই লিখিত নির্দেশে।
বৃহস্পতিবার সকালে ফের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজ্য জানায়, স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও সিবিআইকে এফআইআর রুজু করতে বলেছে সিঙ্গল বেঞ্চ এবং নথিও হস্তান্তর করা হয়েছে। বিরক্ত ডিভিশন বেঞ্চ সেই এফআইআর খারিজের নির্দেশ দেয়। সিবিআইকে নথি ফেরতেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। নথি কেন দেওয়া হলো, তা নিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলেরও কৈফিয়ৎ তলব করে।
খানিক পরে সেই নির্দেশ শুনেই এজলাসে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পর পর যে-সব মন্তব্য করেন তিনি, তার নজির ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় নেই বলেই মত প্রবীণ আইনজীবীদের। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, বিচারপতি সেন স্পষ্টতই একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছেন। তাই সুপ্রিম কোর্টের উচিত তাঁর সব নির্দেশ খারিজ করা। নির্দেশনামা এবং আবেদনপত্রের কপি ছাড়াই সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশের উপরে স্থগিতাদেশ দিচ্ছেন বিচারপতি সেন। যা নিয়মবিরুদ্ধ।
এর পরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিস্ফোরক অভিযোগ,✓’এই মামলায় রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকা ব্যক্তির মতো আচরণ করছেন বিচারপতি সেন। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।’ এর পরেই তাঁর প্রশ্ন, কেন বিচারপতি সেনের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হবে না? এখানেই না থেমে তাঁর এই বিচারবিভাগীয় রায় রেজিস্ট্রার জেনারেলকে কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোরও নির্দেশ দেন তিনি।
এজলাসে তখন উপস্থিত রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত। তাঁর সঙ্গেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় বিচারপতির। এক দিকে অ্যাডোভেকট জেনারেল ‘মুখ না খোলানো’র হুঁশিয়ারি দেন, আবার বিচারপতি তাঁর (এজি’র) পদ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হতভম্ব হয়ে পড়েন এজলাসে হাজির আইনজীবী এবং বিচারপ্রার্থীরা।
এর পরে আরও বিস্ফোরক দাবি করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, বড়দিনের ছুটির আগে বিচারপতি অমৃতা সিনহাকে নিজের চেম্বারে ডেকেছিলেন বিচারপতি সৌমেন সেন। সেখানে বিচারপতি সিনহাকে রাজনৈতিক নেতার মতো তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমত বলেছিলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যত আছে, তাঁকে বিরক্ত না-করতে। দ্বিতীয়ত, বিচারপতি সিনহার এজলাসে অভিষেক সংক্রান্ত মামলা চলাকালীন লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ করতে বলেন।
তৃতীয়ত, প্রাথমিকের দু’টি মামলা খারিজ করারও পরামর্শ দেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, বিচারপতি সিনহা ইতিমধ্যেই গোটা ঘটনা দেশের প্রধান বিচারপতি ও কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েছেন।✓তিনি বিচারপতি সিনহার কাছ থেকেই এ সব জেনেছেন বলে দাবি করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও বিচারপতি সিনহার দিক থেকে কোনও বক্তব্য এ দিন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও দু’বছর ধরে কেন বদলি হচ্ছেন না বিচারপতি সেন, তা নিয়েও এ দিন প্রশ্ন তোলে সিঙ্গল বেঞ্চ। তাঁকে কে বাঁচাচ্ছে–সে প্রশ্নও শোনা যায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে। বিষয়টি দেশের প্রধান বিচারপতিকে দেখার জন্যে অনুরোধ করবেন বলেও জানান তিনি।
ডাক্তারি-ভর্তি নিয়ে সিবিআইয়ের এফআইআর খারিজের যে নির্দেশ ডিভিশন বেঞ্চ দিয়েছে, সে প্রসঙ্গে সিঙ্গল বেঞ্চের বক্তব্য, বিচারপতি সেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নির্দেশ দিয়েছেন, ফলে সেটা বৈধ নয়। এফআইআর খারিজ হবে না। সিবিআই অবিলম্বে তদন্ত শুরু করবে। দু’মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে বলেও নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও ঘটনা হলো, আলিপুরের বিশেষ সিবিআই আদালতে এ দিন সিবিআই ওই এফআইআর জমা করতে গেলেও হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশের পর তা আর গ্রহণ করা হয়নি।
সিঙ্গল বেঞ্চের অনড় মনোভাব নিয়ে এ দিন ফের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল রাজ্যের তরফে। তবে বিচারপতি সৌমেন সেন বলে দেন, ‘এ বিষয়ে আর কিছু বলব না। প্রধান বিচারপতিকে জানান।’ যদিও প্রধান বিচারপতি এ দিন ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ তাই হয়নি। সোমবার কোর্ট খুললে কী হবে–সে নিয়ে জোরদার চর্চার মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষের তরফে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়, যাতে এ দিনের ঘটনাক্রমের যোগ দেখছেন অনেকে।
শিক্ষা সংক্রান্ত সিঙ্গল বেঞ্চের রায় চ্যালেঞ্জের মামলা আর বিচারপতি সেন শুনবেন না বলে জানানো হয়েছে ওই নির্দেশিকায়। সোমবার থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত আপিল মামলা শুনবে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ।
‘রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ব্যক্তির মতো আচরণ করছেন বিচারপতি সেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন’
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
‘এ বিষয়ে আর কিছু বলব না। প্রধান বিচারপতিকে জানান’
বিচারপতি সৌমেন সেন