স্থানীয়রাই ১০৮ নম্বরে ফোন করে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকেন। মিনিট দশেকের মধ্যে নীলগিরি সাব-ডিভিশনাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি বছর ষাটেকের কাপ্তানকে। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে বালাসোর জেলার নীলগিরি থেকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের মধ্যে পাতপুর এলাকায়। স্থানীয়দের উদ্যোগে অন্য চালক এসে তাঁদের নিরাপদে হোটেলে পৌঁছে দিলেও শোকের ছায়া যাত্রীদের মধ্যে। একইসঙ্গে চালকের প্রশংসাও করছেন তাঁরা।
বাসের যাত্রী তথা চালকের পূর্বপরিচিত মহম্মদ মুসির আলির কথায়, ‘নিজের জীবন দিয়ে এতগুলো যাত্রীর প্রাণ বাঁচিয়ে নজির সৃষ্টি করে গেলেন আমাদের কাপ্তান। উনি সময় মতো বাস না-দাঁড় করালে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত। স্থানীয় পুলিশও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। যাতে দ্রুত মৃতদেহ বঙ্গে নিয়ে আসা যায় তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’ ওডিশার কিছু মিডিয়ায় প্রকাশ্যে আসা ছবি-ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, ঘটনার সময়ে বাসটি একটি কালভার্টের উপর ছিল। রাস্তার পাশে চলছিল কাজও। ফলে দুর্ঘটনার একটা আশঙ্কা ছিলই।
তখনও ভালো করে সূর্য ওঠেনি। ফাঁকা রাস্তায় একটা-দু’টো করে ট্যুরিস্ট গাড়ি পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে ঢুকতে শুরু করেছে। রাস্তার পাশে থাকা চায়ের দোকানগুলো সবে খুলেছে। হঠাৎ গরগর শব্দ করতে করতে সবুজ-হলুদ রঙের একটা পেল্লায় বাস দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার পাশে। পাশেই চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পাহাড়ের কোলঘেঁষা গুরুশক্তি হোটেলের কেয়ারটেকার শরৎ রাউত।
এ দিন ফোনে ‘এই সময়’কে তিনি বলেন, ‘কলকাতা টুরিস্ট বাস হঠাৎ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল দেখে ভেবেছিলাম, যাত্রীদের কেউ হয়তো দাঁড় করিয়েছেন। পাত্তা দিইনি। কিন্তু বাসের মধ্যে থেকে একসঙ্গে অনেকের গলা পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম বাসের ড্রাইভার স্টিয়ারিংয়ের উপর ঢলে পড়েছেন।’ তার পরে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা থেকে শুরু করে অসুস্থ চালককে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা অন্য ড্রাইভার জোগাড় করে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয়রা যে ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সে জন্য তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ট্যুরিস্টরা।
হাওড়ার শিবপুর থানার মোল্লা পাড়ায় ২১ নম্বর দানিশ মোল্লা লেনে দু’কামরার ফ্ল্যাটে থাকে কাপ্তানের পরিবার। এ দিন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে তাঁর দেহ এসে পৌঁছতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রতিবেশী ও পরিবারের লোকেরা। স্ত্রী ও ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভরা সংসার ছিল কাপ্তানের। বড় ছেলে আজাদ ও তাঁর পরের ভাই রুটের যাত্রিবাস চালান। ছোট দু’জন এখনও পড়াশোনা করছে। পরিবারের হাল তাই ছিল কাপ্তানের হাতেই।
এ দিন আজাদ জানান, লিলুয়ার জগদীশপুর থেকে সোমবার রাতে যাত্রীদের নিয়ে পুরীর উদ্দেশে বাস ছাড়েন তাঁর বাবা। পথে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর ঘুরে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। ভোর সাড়ে ৪টে নাগাদ এক জায়গায় বাস দাঁড় করিয়ে চা খান কাপ্তান। ৫টা নাগাদ হেল্পারকে বলেন, তাঁর প্রচণ্ড গরম লাগছে। ঘামতে শুরু করেন এবং গায়ের জ্যাকেট খুলে ফেলেন। তার পর হঠাৎ রাস্তার পাশে বাস দাঁড় করিয়ে তিনি ঢলে পড়েন স্টিয়ারিংয়ের ওপর। যাত্রীরা অনেকেই ঘুমোচ্ছিলেন।
হেল্পারের ডাকাডাকিতে তাঁরা উঠে এসে চালকের ওই অবস্থা দেখে স্থানীয়দের সাহায্য চান। হাসিখুশি স্বভাবের কাপ্তান প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন বড় রুটে ট্যুরিস্ট বাস চালিয়েছেন। বরাবরই বাস মালিকদের ভরসার পাত্র ছিলেন। তাঁর সহকর্মী ও পরিবারের বক্তব্য, স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় সকল যাত্রীর নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই চলে গেলেন কুল কাপ্তান।