Homemaker: ঘরের কাজে টাকা পেলেই স্বনির্ভর! – calcutta high court order women who do domestic work should not be treated as unemployed


অবন্তিকা পাল

সোশাল মিডিয়ায় কয়েক বছর আগে একটা রিল ভাইরাল হয়েছিল। বছর পাঁচেকের একটি শিশু তার মাকে বলছে, ‘মা তুমি কত ভালো!’ মা জিজ্ঞেস করছেন, ‘কেন, আমি কী এমন করলাম?’ বাচ্চাটি আপ্লুত হয়ে উত্তর দিচ্ছে, ‘এই যে তুমি আমার ঘরটা এত সুন্দর করে গুছিয়ে দিলে!’ আমরা জানি না, ক্যামেরার পিছনে থাকা মা-টি বাড়িতে সম্পূর্ণ ভাবেই হোমমেকার নাকি কর্মরতা। কিন্তু বাচ্চাটি আমাদের শিখিয়ে দিল, ঘরের প্রাত্যহিক বা আপাত-সামান্য কাজও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

শুধু গৃহকর্ম কেন, যে কাজে সে অর্থে অর্থকরী লাভ কিছু নেই, যেমন ধরা যাক লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখা, কিংবা পাড়ার পিকনিকে মাংস রান্না করা, তেমন সব কাজই মৌখিক স্বীকৃতির দাবি রাখে। কিন্তু বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে তখনই, যখন ঘরের নৈমিত্তিক কাজকে প্রশংসায় সীমাবদ্ধ না রেখে পারিশ্রমিকের আওতায় ফেলার দাবি ওঠে। সম্প্রতি বর্ষশেষে কলকাতা হাইকোর্টে চলা একটি মামলার শুনানিতে বিচারপতি অজয় গুপ্ত জানালেন— ‘কোনও মহিলা অফিসে চাকরি বা ব্যবসা করে টাকা রোজগার না করলেও তিনি দিনের যত সময়ে বাড়ির কাজ করেন, তা পারিশ্রমিক বা বেতনযোগ্য।

এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট মনে করিয়ে দিল ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কথাও, যেখানে সর্বোচ্চ আদালত ব্যাখ্যা করেছিল, যাঁরা বাড়িতে থাকেন তাঁদের বেকার বলে গণ্য করলে চলবে না। প্রতিদিন ১০০ টাকা করে তাঁদের জন্য ধার্য করতে হবে।’ গত এক দশকে সুপ্রিম কোর্ট ও দেশের বিভিন্ন হাইকোর্টের একাধিক ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত মামলায় গৃহবধূদের পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কোথাও বলা হয়েছে মাসে তিন হাজার টাকা পারিশ্রমিকের কথা, তো কোথাও সাড়ে চার কিংবা ছ’হাজার টাকা।

কিন্তু একুশ শতকে দাঁড়িয়ে একটি উন্নয়নশীল দেশে এই পারিশ্রমিক আদতেই নারী-স্বাধীনতার পক্ষে হিতকর কিনা, তা ভেবে দেখা জরুরি। এ বাংলায় শতাব্দীকাল ধরে একটি নিকৃষ্ট প্রথা চলে আসছে। ছেলে বিয়ে করতে যাওয়ার সময়ে মাকে বলে যায়— ‘মা, তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।’ হ্যাঁ, এখনও স্বল্পশিক্ষিত বা গোঁড়া পরিবারগুলোতে এই প্রথা বহাল রয়েছে৷ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক বক্তব্যে সোশাল মিডিয়ায় বহু হোমমেকার স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয়ে লিখলেন— আমরা কি ‘কাজের লোক’ যে নিজের বাড়ির কাজের জন্য মাইনে নেব!

কিন্তু এ বিষয়টি কেবলমাত্র মান-অপমানের নয়। বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে বোঝা যাবে, একজন গৃহবধূকে (বা হোমমেকার) মাসে তিন বা ছ’হাজার টাকা দেওয়া মানেই তার গৃহশ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া নয়। শহরাঞ্চলে একজন গৃহসহায়িকার বেতন ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৭০ টাকা। এই মর্মে বাড়ির কর্ত্রীকে যে অর্থ দেওয়ার কথা আদালত বলছে, তা হিসাব করলে গৃহবধূর পারিশ্রমিক দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৫ টাকা। এখন গৃহকর্তা বলবেন— ওকে আমি খেতে-পরতে দিচ্ছি৷ তার জন্যও মাসে একটা বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ সমগ্র বৈবাহিক সম্পর্কটাই তখন গিয়ে পৌঁছবে আয়-ব্যয়ের হিসাবে।

গৃহশ্রমের বেতন চালু হলে বিয়ে করার সময়ে পুরুষের পরিবার থেকে সেই ধরনের মেয়েকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, যে গৃহকর্মনিপুণা, যেমনটা দেওয়া হয়েছে গত শতাব্দী পর্যন্ত। ‘মেয়ে দেখতে এসে’ তার যাবতীয় ডিগ্রি, কর্মজগতের সাফল্য, স্বভাব, ইত্যাদিকে ছাপিয়ে প্রাধান্য দেওয়া হবে তার বাসন মাজা ও মাছের কালিয়া রান্না করাকে। অর্থাৎ আবারও ছেলেটি হবে বাড়ির ‘কর্তা’ এবং মেয়েটি ‘দাসী’। রাষ্ট্র নির্ধারিত পারিশ্রমিক স্পষ্টতই দুই দাম্পত্যসঙ্গীর মধ্যে একটি অলিখিত টেবিল তৈরি করবে, যেখানে পুরুষটি ‘বেনিফ্যাক্টর’ অর্থাৎ ‘সুপিরিয়র’, এবং নারীটি ‘বেনিফিশিয়ারি’ অর্থাৎ ‘ইনফিরিয়র’।
West Bengal Budget 2024: লক্ষ্মী দিয়ে ভোটলক্ষ্মী বাজেট

মফসসলের জাহানারা পারভিন বরাবর পড়াশোনায় কৃতী ছাত্রী। গ্র্যাজুয়েশনের পর তিনি চেয়েছিলেন এমএ এবং বিএড করে শিক্ষিকা হতে। কিন্তু বিএ পাশ করতে না করতেই তাঁর মা-বাবা জানান, তাঁর জন্য পাত্র ঠিক করা হয়ে গেছে৷ জাহানারা এখন এক ছ’বছর বয়সী কন্যাসন্তানের মা। শ্বশুরবাড়ি থেকে ক্রমাগত চাপ আসছে পুত্রসন্তানের জন্য। ২৯ বছর বয়সেও দাম্পত্যসঙ্গীকে ও তাঁর বৈবাহিক পরিবারকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছে, অন্তত ডিস্ট্যান্স কোর্সে মাস্টার্স করে তিনি যদি বেসরকারি স্কুলে পড়াতে পারেন।

জাহানারাকে গৃহশ্রমের জন্য বেতন দেওয়া শুরু হয়ে গেলে তাঁর এই ‘আইডেন্টিটি’ নির্মাণের লড়াই আচমকাই থেমে যাবে৷ তাঁর বৈবাহিক পরিবার এই যুক্তিতে দৃঢ় হবে যে, জাহানারা তো বাড়ির কাজ করেই মাসে ছ’হাজার পারিশ্রমিক পাচ্ছেন৷ তা হলে তাঁর বাইরে যাবার দরকারটা কী! গত শতকের আশি-নব্বইয়ে কিংবা নতুন সহস্রাব্দে জন্মানো যে মেয়েরা চাকরি করে বা ব্যবসা চালিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে, গৃহকর্মের পারিশ্রমিক চালু হলে তাঁদের স্বাধীনভাবে বাঁচার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তাই গৃহবধূর পারিশ্রমিক নয়, বরং এ দেশে এখন যা দরকার, তা হল ছেলেটি ও তার পরিবারকে শিক্ষিত করা। স্কুল পাঠক্রমে জেন্ডার এডুকেশনের মধ্যেই এই কথাগুলোকে ঢুকিয়ে দেওয়া যে, ছেলে হোক বা মেয়ে, বাইরে বেরিয়ে কাজ করা সকলের অধিকার। এবং মেয়ে হোক বা ছেলে, গৃহকর্মগুলোকে সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়া একটি আধুনিক সমাজের নৈতিক কর্তব্য।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *