দিন পনেরো আগেও স্বপ্নের মতো ছিল আবীরা দাসের জীবনটা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সরকারি চাকরি করেন। নিশ্চিন্ত সংসারে রয়েছে সাড়ে তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে। খেদ বলতে একটাই। চাকরির সুবাদে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে বিশেষ থাকা হয় না। স্বামী অরূপ বিশ্বাস মালদহের একটি স্কুলে বাংলার শিক্ষক। মালদহেরই মেয়ে আবীরা এসএসসি পাশ করে চাকরি করেন শ্রীরামপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে।সোমবার হাইকোর্টের রায়ে চাকরি যাওয়া প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে আবীরার নামও। মেধাবী তরুণীর সাজানো সংসার ছারখার করে দিয়েছে আরও একটি ঘটনা। ১২ দিন আগেই আকস্মিক অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছে আবীরার স্বামী অরূপের। জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই চাকরি হারিয়ে রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন আবীরা।
২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় সফল হন মালদার ইংলিশবাজারের বাসিন্দা আবীরা। ২০১৮ সালে হুগলি জেলার সেরা স্কুলগুলির একটি শ্রীরামপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সহশিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা সাহিত্য পড়াতেন আবীরা। একমাত্র সন্তান আরোহীকে নিয়ে সুখের সংসার দম্পতির। স্বামী মালদহে থাকলেও কর্মসূত্রে শ্রীরামপুরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন আবীরা।
গরমের ছুটি পড়ার আগেই ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে জমা দিয়েছেন তিনি। গত ৭ এপ্রিল খবর পান স্বামী অরূপ আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সে দিনই মেয়েকে নিয়ে মালদহে ছুটে যান আবীরা। পরের দিন ৮ এপ্রিল মৃত্যু হয় অরূপের। আবীরার শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে নেই। স্বামীর মৃত্যুতে শিশুকন্যাকে নিয়ে শোকের ভার সামলানোর আগেই সোমবার আসে হাইকোর্টের রায়।
মালদহ থেকে কান্নায় আকুল হয়ে মেধাবী তরুণী বলেন, ‘আমাদের সমস্ত নথিপত্র জমা দিয়েছি। যতবার ডাকা হয়েছে, ততবার গিয়েছি। তদন্তে সমস্ত রকম সহযোগিতা করেছি। অযোগ্যদের যে তালিকা বেরিয়ে ছিল তাতে আমার নাম ছিল না। তারপরেও আদালতের নির্দেশে আমরা নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করার পরেও চাকরি হারালাম। আমার বৃদ্ধা মা ও বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাব? আমার স্বামীও মারা গিয়েছেন। আমাদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হয়ে গেল।’
চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন আবীরা। সেই ঋণ কী ভাবে শোধ করবেন সেই চিন্তাও পাগল করে দিচ্ছে তাঁকে। এ দিন অসহায় ভাবে আবীরার প্রশ্ন, ‘আমাদের কী অন্যায়? আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার আগেই আমাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হলো।’ শ্রীরামপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অবশ্য একা আবীরা নন, হাইকোর্টের নির্দেশে এই স্কুলে চাকরি গিয়েছে আরও তিন জনের। মোট চারজন শিক্ষিকার মধ্যে দু’জন বাৼ৾ংলার ও দু’জন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষিকা।
জেলায় অত্যন্ত সুনাম এই স্কুলটির। প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় জায়গা করে নেয় এই স্কুলের ছাত্রীরা। গরমের ছুটির পর এতজন শিক্ষিকার অভাব কী ভাবে পূরণ হবে তা ভেবে পাচ্ছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, যে চার শিক্ষিকার চাকরি গিয়েছে, তাঁদের কারও নামই অযোগ্যদের তালিকায় ছিল না।
প্রধান শিক্ষিকা আইভি সরকার বলেন, ‘আমরা সমস্ত নথিপত্র জমা দিয়ে ছিলাম পর্ষদে। প্রত্যেক শিক্ষিকাই দক্ষতার সঙ্গে পড়িয়েছেন। আবীরার স্বামী সদ্য গত হয়েছেন। ওর কথা ভেবে আমাদের মন খুব খারাপ।’