‘দাদা, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ কর্মসূচি কী?’ প্রশ্নটা শুনে নিজের কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বোলালেন বউবাজার এলাকার এক মাঝবয়সী তৃণমূল নেতা। তারপর উদাস চোখে আকাশের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তাপস রায়ের হয়ে আজ মিঠুন চক্রবর্তী প্রচার করতে আসছেন। মঙ্গলবার তো প্রধানমন্ত্রী রোড-শো করে গেলেন! হুডখোলা জিপে মোদীর পাশেই তাপসদা ছিলেন।’—মানে, আপনার দলের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মসূচি জানতে চাইছিলাম! আজ ওঁর প্রচার কোথায়? তাতেও অভিব্যক্তি বদলাল না ওই তৃণমূল নেতার। একইভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘জানি না। হবে কোথাও একটা। তবে সুদীপদাই জিতবেন। কারণ, উনি তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন।’
১০৫, বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট। কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের ফ্ল্যাট বাড়ি। তিনতলায় থাকেন তাপস। গ্রাউন্ড ফ্লোরে বিজেপির নির্বাচনী কার্যালয়। তবে বিজেপির নির্বাচনী কার্যালয় বললে অনেকেই তার হদিশ দিতে পারবে না। যেমন, স্থানীয় এক দোকানির কথায়, ‘তাপসদার অফিস খুঁজছেন, সেটা বলবেন তো। বিজেপি অফিস বললে কীভাবে বুঝব! সোজা মিনিটখানেক হাঁটুন। রাস্তার বাঁদিকে পড়বে। দাদা এখন বাড়িতেই আছেন। মোবাইল নম্বর লাগবে? তাপসদা সবার ফোন তোলেন।’
উত্তর কলকাতা বহু রাজনীতিকের উত্থান-পতনের সাক্ষী। ভোট নিয়ে বরাবরই বড্ড মাতামাতি এই পুরোনো কলকাতায়। তবে এ বার যেন লড়াইটা কিছুটা অন্যরকম। প্রতীক ছাপিয়ে এ বার সেখানে চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে যুযুধান দুই শিবিরের প্রার্থীরা। বিজেপির ‘বিকশিত ভারত’-এর ভাবনা অথবা তৃণমূলের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মধ্যে টক্কর গোটা বাংলার মতো উত্তর কলকাতাতেও আছে।
কিন্তু সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি তাপস রায়, জনতার দরবারে কার হাজিরা বেশি, আগামী শনিবার বুথে যাওয়ার আগে সেই পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণই সম্ভবত যাচাই করে নিতে চাইছেন এখানকার ভোটাররা। সেই অটরবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আদবানিদের জমানা থেকে উত্তর কলকাতায় ভোটে লড়ছে বিজেপি। কিন্তু ‘আমরাও জিততে পারি’ এই ধারণা অতীতে কখনও দানা বাঁধেনি এখানকার বিজেপি নেতা-কর্মীদের মনে।
এ বার সুদীপ বনাম তাপস টক্করে কে শেষ হাসি হাসবেন, সেটা বোঝা যাবে আগামী ৪ জুন। কিন্তু ‘এ বার হলেও হতে পারে’ গোছের কনফিডেন্সটুকু অন্তত কলকাতা উত্তরের বিজেপি কর্মীদের মধ্যে আমদানি করতে পেরেছেন তাপস। বঙ্গ-বিজেপির এক শীর্ষ নেতা মুচকি হেসে বললেন, ‘উত্তর কলকাতায় পদ্মের মরা গাঙে বান এনেছেন তাপসদা। এটা কি কম বড় প্রাপ্তি? হারা-জেতা তো পরের কথা। তাছাড়া সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আগে উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের সব গোষ্ঠীকে এক সূত্রে গাঁথুন, তারপর ফুরসত পেলে তাপসদার সঙ্গে লড়াই করবেন।’
তবে উত্তর কলকাতার এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘তাপসদা প্রার্থী হয়েছেন বলে গেরুয়া শিবিরে বাড়তি একটা জোশ এসেছে ঠিকই, আগের মতো মনমরা ব্যাপারটা আর নেই। কিন্তু মানুষ তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোড়াফুল প্রতীকে ভোট দেবেন। সেই জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও দাঁড়াতে পারবেন না বিজেপির তাপস রায়।’
তবুও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশপাশে ঘোরা তৃণমূল নেতাদের মনে কয়েকটা প্রশ্ন খচখচ করছে—‘তাপস রায়ের অনুগামীদের এত কনফিডেন্স আসছে কোথা থেকে? কোন সমীকরণে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন তাঁরা? উত্তর কলকাতায় সংখ্যালঘু ভোটার যে ২২ শতাংশ। তাঁরা কি আর বিজেপিকে ভোট দেবেন?’
তিনতলার সোফাসেটে বসে আড়মোড়া ভাঙলেন তাপস। রিং হতে থাকা মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফোনটা ধরে নিই। হয়তো কেউ বিপদে পড়ে ফোন করেছেন। আমি সবার ফোন ধরি। ধরতে না পারলে কিছুক্ষণের মধ্যেই কলব্যাক করি।’ এরপর ফোনের ওপারে থাকা বিজেপি কর্মীর সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক কথাবার্তা সেরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম…এই কেন্দ্রে তৃণমূলের দু’টো বিপদ। এক, তৃণমূলের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরক্তি। দুই, তৃণমূল প্রার্থীর প্রতি মানুষের আরও বিরক্তি।’
তাঁর সংযোজন, ‘আমি এলাকার মানুষের কাছে তাপসদা। সেখানে কোনও ধর্ম নেই, রাজনীতির রং নেই। আমার কাছে সবার অবারিত দ্বার। এটা এলাকার তৃণমূল, সিপিএম কর্মীরাও জানেন।’ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তাপস কী ভাবছেন সেটা তো বোঝা গেল। কিন্তু তাপসকে আদৌ কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন সুদীপ? সেটা জানার জন্য উত্তর কলকাতার বিদায়ী সাংসদ সুদীপকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন তোলেননি। মেসেজেরও জবাব দেননি।
বিজেপির কার্যলয়ের বাইরে ঘুরঘুর করছিলেন তাপস রায়ের ঠিকানা বাতলে দেওয়া সেই দোকানি। দেখা হতেই চাওড়া হাসি হেসে বললেন, ‘কথা হলো তাপসদার সঙ্গে? বললাম না, দাদা সবার ফোন তোলেন।’