এলাকার ‘বাহুবলী’ তৃণমূল নেতা, পেশায় প্রোমোটার রাজু নস্করের অফিসে আচমকা হাজির হলেন দলেরই নেতা কুণাল ঘোষ। তাপস রায় বিজেপিতে যোগদানের পরেও একটি রক্তদান শিবিরের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কুণালের গলায় শোনা গিয়েছিল ‘ব্যক্তি’ তাপসের প্রশংসা এবং ঘটনাপরম্পরায় সেই দিনই রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় কুণালকে।
কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের ভোটের মাত্র ক’দিন আগে নির্বাচনী প্রচার শেষে সুদীপ ও কুণালকে আলাদা করে কিছু কথা বলতে দেখা গিয়েছিল তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। সেই কুণাল এদিন হঠাৎ হাজির রাজু নস্করের অফিসে! যে রাজুর দলবলের বিরুদ্ধে অতীতে ভোটের দিন দেদার গাজোয়ারির অভিযোগ তুলত বিরোধীরা—সে বাম জমানাতেই হোক অথবা জমানা বদলের সঙ্গে রাজু জার্সি বদলের পরেও!
কুণালের কিছুক্ষণের মধ্যে রাজুর অফিসে হাজির হলেন বেলেঘাটার তৃণমূলের বিধায়ক পরেশ পাল। এবং, কার্যত তাঁর পিছু পিছুই পৌঁছলেন তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং! কী এমন হলো যে, দলের তিন মূর্তিকে হাজির হতে হলো সেখানে? সে প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর শনিবার রাত পর্যন্ত নেই। তবে এই বৈঠকে না থেকেও যেন থেকে গেলেন আর এক জন— এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী, প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়।
কারণ, তাঁকে রুখতেই নাকি ভর দুপুরে এমন ক্লোজ়ড ডোর বৈঠক। স্বাভাবিক ভাবেই চর্চা শুরু হয়েছে, তা হলে লড়াই কি এতটাই কঠিন যে, মাঝ পথে স্ট্র্যাটেজি বৈঠকে বসতে হচ্ছে প্রার্থীকে? তিন নেতা যখন রাজুর অফিসে গেলেন, তখন সেখানে অন্তত শ’খানেক তৃণমূলকর্মীর ভিড়। ঘণ্টাখানেক ধরে চলল বৈঠক। কিন্তু তার কি মধুরেণ সমাপয়েৎ হলো? বৈঠক শেষে আর কোনও মন্তব্যই করতে রাজি হননি সুদীপ।
কুণাল রাজুর অফিসে গেলেও পরেশকে জানিয়ে যাননি। তা হলে পরেশ সেখানে গেলেন কী করে? পরেশ বলছেন, ‘আমাকে তো দিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ফোন করে বললেন, কুণাল ওখানে গিয়েছে, তুমি যাও। তাই আমি এলাম।’ সুদীপের তো বুথে বুথে ঘোরার কথা। তিনি কেন এলেন? সুদীপ বলেন, ‘আমি কুণালকে ফোন করেছিলাম। ও-ই বলল যে, রাজুর অফিসে আছে। সেই জন্যই তো আমি এলাম।’
আর কুণাল বলছেন, ‘প্রচারমঞ্চ থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, রাজু নস্করকে জেলে পোরা হবে। ভোটবাজারে যাতে ওরা ভয় না-পায়, তাই মর্যাল সাপোর্ট দিতে গিয়েছিলাম।’ ‘ভোট করিয়ে’ রাজুর সঙ্গে যখন নেতা-ত্রয়ীর বৈঠক চলছিল, তখন যে শ’খানেক কর্মী রাজুর অফিসে ছিলেন, বৈঠক শেষের পরেও তাঁরা সেখানেই থেকে গেলেন।
বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, ভোট যাঁরা করেন তাঁরা রাস্তায় না নামলে ভোট কী করে হবে? তার উত্তর দিলেন রাজু। তিনি বলেন, ‘এখন তো আর আগের মতো ভোট হয় না। এখন ভোট হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়, হাইটেক ভোট। ভোট ঠিকঠাকই হচ্ছে। আর সব ভোট সুদীপদার বাক্সে জমা পড়ছে।’ আর সুদীপের ছোট্ট অথচ ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘ন’বার সাংসদ হয়েছি। এবারও তৃণমূল জিতবে।
রাজু মাঠে থাকলে মার্জিন হয়তো আরও বাড়ত।’ শেষমেশ ফল কী হবে, তা বোঝা যাবে মঙ্গলবার। তবে সম্ভবত বেলেঘাটার এই মিটিংয়ের দিকে একইসঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে সুদীপ-পরেশ-কুণাল ত্রয়ীর, এবং তাপসেরও। সুদীপের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তাপস একদা তাঁরই সতীর্থ ছিলেন। একই ফুলের ছায়ায় থাকাকালীনও দু’জনের সম্পর্ক যে সুমধুর ছিল না, সেটা বলাই বাহুল্য। এদিন প্রতিদ্বন্দ্বীকে চাপে রাখতে দিনভর ছুটে বেড়ালেন তাপস। বিজেপির গড় হিসেবে পরিচিত সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে গো-ব্যাক স্লোগান শুনতে হলো তাপসকে।
কিন্তু, অন্য প্রান্ত থেকে পাল্টা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুরু হলো অচিরেই। এবং, শব্দের মাত্রা শাসক দলের তুলনায় কিছু কম নয়। সুদীপ যদিও বলছেন, ‘আমি ন’বার জিতেছি। এবার জীবনে সব থেকে বেশি ভোটে জিততে চলেছি।’ আর তাপসের দাবি, ‘আমি ২০১৯ সালেও ওঁর হয়ে ভোট করিনি। আর এবার ১ লক্ষের বেশি ভোটে আমিই জিতব।’ চর্চার কেন্দ্রে না-থাকলেও কেন্দ্রের আদ্যোপান্ত চষে বেড়িয়েছেন আশি ছুঁই ছুঁই প্রদীপ ভট্টাচার্যও।