অবিরত ধারাস্নান, ময়েস্ট হিটওয়েভ বাড়াচ্ছে অস্বস্তি – south bengal again influence of heat wave know weather forecast


চামড়া পোড়ানো এপ্রিলের পর দমবন্ধ করা জুন। আবারও ‘তাপপ্রবাহের’ কবলে দক্ষিণবঙ্গে। তবে এপ্রিলেরটা ছিল ‘ড্রাই হিটওয়েভ’ আর এটা ‘ময়েস্ট হিটওয়েভ’। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির নীচে থাকলেও শুধু বাতাসের জলীয় বাষ্পও যে কতটা নির্মম ভাবে জীবনীশক্তি নিংড়ে নিতে পারে, গত কয়েক দিন ধরে সেটাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গ। এপ্রিলের যে ‘ড্রাই হিটওয়েভে’ ঝলসে গিয়েছিল বাংলা, সেখান থেকে তবু মুক্তির উপায় ছিল। ছায়ায় থাকলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যেত।কিন্তু জুনের এই ‘আর্দ্র তাপপ্রবাহ’ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ২৪ ঘণ্টা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকা- যা বাস্তবে সম্ভব নয়। আর সে জন্যই ঘামের অবিরাম ধারাস্নানে ভিজে গোটা দক্ষিণবঙ্গ পরনের জামা-কাপড় শুকোনোর সুযোগই পাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় কলকাতার তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ঘোরাফেরা করেছে ৯০ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশর মধ্যে। তারই দৌলতে ‘রিয়েল ফিল’ পৌঁছে গিয়েছিল ৫০ ডিগ্রিতে। অর্থাৎ ৩৫ ডিগ্রিতেই শহরবাসী ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনুভূতি পেয়েছেন। কেবল এই দু’টো সংখ্যাতেই স্পষ্ট, অস্বস্তি কতটা।

এ দিন বিকেলে অবশ্য মেঘের সঞ্চার হয়েছিল কলকাতা ও আশপাশের আকাশে। তবে আরাম দেওয়ার বৃষ্টি নামাতে পারেনি সেই মেঘ। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয় দু’-একটি এলাকায়। মৌসম ভবন জানাচ্ছে, কেরালা দিয়ে ভারতে জলীয় বাষ্পে পরিপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবেশের নির্ধারিত সময় ১ জুন। এ বার কেরালায় জলীয় বাষ্পে ভরা ওই বাতাস ঢুকেছে ৩০ মে। অন্য দিকে, উত্তর-পূর্ব ভারতের দরজায় মৌসুমি বাতাস কড়া নাড়ে জুনের ৫-৬ তারিখে।

নাজেহাল বাংলা

এ বার সেভেন সিস্টার্‌স বা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটা রাজ্যেই বর্ষা শুরু হয়েছে কেরালার সঙ্গে- নির্দিষ্ট সময়ের দিন সাতেক আগে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের পাশাপাশি দার্জিলিং জেলা লাগোয়া উত্তর দিনাজপুর জেলার যে সব জায়গা, সেখানেও বৃষ্টি শুরু হয়েছে ২ জুন- নির্দিষ্ট সময়ের তিন দিন আগে। দক্ষিণ ভারতের কেরালা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশ এখন পুরোপুরি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বাতাসের দখলে।

অন্ধ্রপ্রদেশের রায়লসীমার অর্ধেক এলাকা-সহ মহারাষ্ট্রের কিছুটা জায়গাতেও ঢুকে পড়েছে এই বাতাস। উত্তরবঙ্গে বর্ষা শুরুর পরে দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব ক’টা জেলারই বাতাস ছেয়ে গিয়েছে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্পে। তাতে কিন্তু বৃষ্টি নামছে না। আবার একদিকে সেই জলীয় বাষ্পের বাড়বাড়ন্ত এবং অন্য দিকে বৃষ্টির অভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি- দুইয়ে মিলে ‘ময়েস্ট হিটওয়েভ’ বা আর্দ্র তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

তার প্রভাবে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলা- যেগুলো শুকনো গরমের জন্য কুখ্যাত- সেই সব জেলাতেও এখন ঘাম হচ্ছে কুলকুলিয়ে। গত কয়েক দিনে দক্ষিণবঙ্গে আর্দ্রতাজনিত অস্বস্তি যে চরম জায়গায় গিয়েছে, সেই প্রসঙ্গে আইআইটি বম্বের জলবায়ু বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষক রঘু মুর্তুগুড্ডে বলছেন, ‘ড্রাই হিটওয়েভে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অন্তত ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে হয়। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাকে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হতে হয়। কিন্তু ময়েস্ট হিটওয়েভে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কম হলেও আপেক্ষিক আর্দ্রতা অত্যন্ত বেশি থাকায় জলীয় বাষ্প যেন ভিজে তোয়ালে মুখে চেপে বসার মতো দম বন্ধ করে দেয়। ওডিশা ও দক্ষিণবঙ্গে এখন তেমনটাই হচ্ছে।’

ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে পূর্ব উপকূল বরাবর এমন ‘ময়েস্ট হিটওয়েভ’ নিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত বিজ্ঞানপত্রিকা ‘নেচার’-এ একযোগে এ দেশের ৯ জন আবহবিদের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। ওই গবেষণাপত্র অনুযায়ী, ‘ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে ড্রাই হিটওয়েভের প্রাবল্য বেশি। তবে ময়েস্ট হিটওয়েভ প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে।’

আবহবিদরা বলছেন, ‘ভয়াবহতা’-র বিচারে ‘ময়েস্ট হিটওয়েভ’ কিছু কম নয়। ড্রাই হিটওয়েভের জন্য মূলত ‘বিপজ্জনক পরিস্থিতি’ বা ‘কশান’ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আর্দ্র তাপপ্রবাহে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বা ‘এক্সট্রিম কশান’ এমনকী ‘গুরুতর বিপদ’ বা ‘ডেঞ্জার’-ও ঘোষণা করতে হয়।’ অতি দ্রুত শরীরের জল বেরিয়ে যাওয়ার ফলে প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই প্রাণহানিরও আশঙ্কা থেকে যায় এমন পরিস্থিতিতে।

কিন্তু বাতাসে ভরপুর জলীয় বাষ্প থাকা সত্ত্বেও কেন বৃষ্টি নামছে না দক্ষিণবঙ্গে? আবহবিদরা বলছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু হিমালয়ে ধাক্কা খাওয়ার পর উত্তরবঙ্গে ঢুকে বৃষ্টি নামায়। ওই হাওয়া ক্রমশ দক্ষিণের দিকে এগোলে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়। কিন্তু আপাতত অসমের উপর একটি ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হওয়ায় ওই হাওয়া উত্তরবঙ্গে কয়েক দিন আটকে রয়েছে।’

ঘাম প্যাচপ্যাচে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আকাশে কালো মেঘ, পুরোপুরি স্বস্তি মিলবে কবে?

আবার, মধ্যপ্রদেশের উপর তৈরি অন্য একটি ঘূর্ণাবর্ত থেকে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা বাংলার উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তার প্রভাবে সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকেই চলেছে। যা আর্দ্রতাজনিত অস্বস্তিকে চরমে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা শুরু না-হলে এই অবস্থা থেকে কোনও পরিত্রাণ নেই বলে মনে করা হচ্ছে। দক্ষিণে কবে নামতে পারে বর্ষা?

আলিপুর হাওয়া অফিসের আঞ্চলিক অধিকর্তা সোমনাথ দত্ত বলছেন, ‘আমার হিসেব বলছে, দক্ষিণবঙ্গে প্রকৃত বর্ষা ১০-১৩ জুনের আগে নামার আশা কম। আপাতত বিক্ষিপ্ত ভাবে প্রাক-বর্ষার বৃষ্টির সম্ভাবনাই বেশি।’ এই প্রাক-বর্ষা পরিস্থিতিতেই এ দিন বিকেলে মেঘের সঞ্চার হয়েছিল।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *