Kanchanjungha Express Accident : দোয়া শেষে জান কুরবান প্রাণরক্ষায়, পড়ে রইল কুরবানির মাংস – phansidewa nirmal jot villagers help to save kanchanjunga express passenger


সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
কুরবানিকে কুরবান করেই ছুট লাগালেন ওঁরা! সামনে তখন আর্তের হাহাকার। কুরবানির ইদের দিনে ওঁদের কাছে কর্তব্যটাই বড় হয়ে উঠল। ইদের নমাজ় শেষে বাকি দিনের যাবতীয় পরিকল্পনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের দিকে নির্মল জোত গ্রামের বাসিন্দারাই বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত।সোমবার তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা ১০। ইদের নমাজ় সবে শেষ হয়েছে। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি। কথা ছিল নমাজ় শেষ করে সৌহার্দ্যের কোলাকুলি সেরে সবাই মিষ্টি মুখ করবেন। দুপুরে গ্রামের ঘরে ঘরে রান্না হবে কুরবানির মাংস। আচমকাই প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা গ্রাম। মসজিদ থেকে ছাতা মাথায় বাড়ির পথে পা বাড়ানো ফজলুর, তালেব, মফিজরা চমকে উঠে দেখলেন, একটা ট্রেনকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছে একটা মালগাড়ি।

মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপরে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রেনের পিছনের কামরা। যেন সিনেমার কোনও ভয়ঙ্কর দৃশ্য। মুহূর্তেই সম্বিৎ ফেরে ফজলুরদের। ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গিয়েছে বুঝে সবাই ছাতা ফেলে ছুট লাগালেন রেললাইনের দিকে। পুলিশ, অ্যাম্বুল্যান্সকে খবর দেওয়ার পাশাপাশি ভেঙে তছনছ হয়ে যাওয়া কামরার ভিতর থেকে নিহত ও আহত রেলযাত্রীদের বের করে আনার কাজটা শুরু করলেন তাঁরাই। কোথায় কে আছে, কে বেঁচে, কে মরে সেটা তখনও মাথায় ঢোকেনি। সব কিছু ভুলেই উদ্ধারকাজে ঝাঁপালেন ফজলুররা।

বৃষ্টিতে কাকভেজা ভিজে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিনভর লড়ল গোটা গ্রাম। পিছনে রইল ইদের মিষ্টিমুখ, কুরবানির মাংস। ফাঁসিদেওয়া থানার নির্মল জোত গ্রামের মাঝ বরাবর তিস্তার বড় একটা নালা রয়েছে। চাষের জল মেলে সেখান থেকেই। দু’পার মিলিয়ে বসবাস শ’তিনেক পরিবারের। গ্রাম থেকে একশো মিটার দূরে রাঙাপানির বুক চিরে গিয়েছে রেললাইন। ফজলুর, আফাজ়রা রেললাইনের দিকে ছুটতে ছুটতেই ফোন করে পরিচিত অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভারকে ডেকে নেন।

পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগে ট্রেন থেকে কয়েকজন জখম যাত্রীকে কাঁধে তুলে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেন তাঁরা। পুলিশ ও উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর পরে দুমড়ে যাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘার কামরা রেললাইনের পাশের চাষের জমিতে নামানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া থেকে শুরু করে রেল ও প্রশাসনের কর্তাদের হাতে হাতে আহত-নিহতদের বের করে আনার কাজও করলেন গ্রামের বাসিন্দারা।

এসব করতে করতেই পেরিয়ে গেল কুরবানির সময়। গ্রামে দুপুরে কুরবানির মাংস রান্না হলো না। যাঁরা শিলিগুড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তাঁদের প্ল্যানও ভেস্তে গেল। তাতে অবশ্য দুঃখ নেই নির্মল জোতের ফজলুর রহমানদের। তাঁর কথায়, ‘ইদ আবার আসবে। কিন্তু চোখের সামনে এমন দুর্ঘটনা দেখে কি চুপ করে বসে থাকা যায়?’ গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ নাজিসকে ‘টাট্টু ঘোড়া’ বলে ডাকেন গ্রামের লোকজন।

এদিন সকাল ৮টা ৫০-৫৫ নাগাদ দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তিনিই সবার আগে ছুটে এসে পৌঁছন দুর্ঘটনাস্থলে। দেখেন, একটা কামরা ছিটকে আপ লাইনে চলে এসেছে। সেখান থেকে একটা মানুষের শরীরের অধের্কটা বের হয়ে রয়েছে। পরে তিনি জানতে পারেন, ওই ব্যক্তি আসলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড। তাঁকে বের করে এনে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালে।

দুর্ঘটনার অভিঘাতে ট্রেন থেকে ছিটকে রাস্তায় এসে পড়ে একটা বাচ্চা মেয়ে। মাথা থেকে অঝোরে রক্ত বের হচ্ছিল। ফজলুর তাঁকে কোলে তুলে নেন। পরে তিনি বলেন, ‘মেয়েটাকে দেখে আমার মেয়ে ফরজ়ানার কথা মনে হলো। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সোজা রাঙাপানিতে পৌঁছলাম। তার পরে পরিচিত একজনকে দিয়ে ফাঁসিদেওয়া হাসপাতালে পাঠালাম। আসলে ইদের দিন সকালে এমন দৃশ্য দেখতে হবে, ভাবিনি।’

ইদে বাড়ি ফেরা হল না, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল গৃহবধূর

গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আরও আধঘণ্টা বাদে আসেন রেলের নিরাপত্তা কর্মীরা। নির্মল জোত গ্রামের এক বাসিন্দা মেহবুব আলম বলেন, ‘রেল পুলিশেরই তো আগে পৌঁছনো উচিত ছিল। আরও একটু আগে যদি কামরা থেকে লোকগুলোকে বের করা যেত, তাহলে হয়তো আরও দু’-একজনকে বাঁচানো যেতে পারত। অবশ্য বেশ কয়েকজন জখম ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা আমরা করতে পেরেছি। এটাই আমাদের কাছে বড় স্বস্তি।’

আর এক বাসিন্দা মহম্মদ মুস্তাফার কথায়, ‘চোখের সামনে এতগুলো মৃত্যু দেখে গোটা গ্রামের মন খারাপ। দুপুরে কারও বাড়িতে রান্না হয়নি।’ নমাজ় সেরে আহতদের বাঁচাতে ছুটেছিলেন মহম্মদ রাহুলও। দুর্ঘটনার মুহূর্তের ভয়াবহতা তিনিও যেন ভুলতে পারছেন না। তাঁর কথায়, ‘ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠেছিল আমাদের গোটা গ্রাম। বিকেলে বাড়ি ফিরে শুনলাম, কুরবানি হয়নি। আমার স্ত্রী জানালো, গোটা গ্রামেই আজ মাংস রান্না হয়নি। তাতে অবশ্য আমাদের খেদ নেই।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *