ভূমি রাজস্ব দপ্তর: ‘টাকাটাই শেষ কথা, বাকি সব বাতুলভা…’ – forest department officer to prevent encroachment of government land in jhargram


এই সময়: মাস দুই আগের ঘটনা। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জে ভূমি রাজস্ব দপ্তরে ‘জ্যান্ত ভূত’ দেখে চমকে উঠেছিলেন বিএলএলআরও। কৃষ্ণগঞ্জের পোড়াগাছা গ্রামের অঙ্গ ধাড়াকে মৃত দেখিয়ে তাঁর জমি নিজের নামে করে নিয়েছিলেন ভাগ্নে নিতাই। সেই অঙ্গ হাজির হওয়ায় ব্লক ভূমি রাজস্ব আধিকারিক সরকারি নথি সংশোধনের আশ্বাস দিলেও জালিয়াতির নেপথ্যে থাকা দপ্তরের কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ।ঝাড়গ্রামের অর্জুনডহর এলাকায় লোধা-শবরদের প্রায় আট বিঘা জমির ‘দলিল’ বের করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল কয়েক মাস আগে। মহকুমাশাসকের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্তে নেমে পুলিশকর্মী, সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারি ভাবে পাট্টা দেওয়া লোধা-শবরদের জমি বিক্রি বেআইনি হলেও কী করে অন্যদের নামে রেকর্ড করা হলো, তার উত্তর নেই।

শাস্তি হিসেবে ভূমি রাজস্ব দপ্তরের এক আধিকারিককে বদলি করা হয়। ব্যাস, তারপর সব ধামাচাপা পড়ে যায়। এই ছবি দুই জেলার হলেও রাজ্যজুড়েই ছড়িয়ে জমির সিন্ডিকেট। তাদের দৌরাত্ম্যে একটাই প্রশ্ন উঠেছে, ভূমি দপ্তরে নথিভুক্ত জমির চরিত্র কী করে বদলে দেন জমি মাফিয়ারা! প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, মূলত ভূমি রাজস্ব দপ্তরের বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মীরাই জমির চরিত্র বদলের নাটের গুরু।

হাতে গরম নমুনা হলো শিলিগুড়ির সেবক রোডের রামকৃষ্ণ মিশনের জমি। কয়েক কোটি মূল্যের ওই জমির দলিল নিজের নামে করার অভিযোগ উঠেছে প্রদীপ রায়ের বিরুদ্ধে। পাঁচ দশক আগে ওই জমির মালিক ছিলেন টুকরা সিংহ। তিনি জমিটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন হরদয়াল সিং নামে এক ব্যক্তিকে। হরদয়াল ওই জমিতে দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। জমির চারপাশ ঘিরে গাছ লাগিয়ে সুন্দর একটি কম্পাউন্ড তৈরি করেন।

পরে তিনিও জমিটি বিক্রি করে দেন এস কে রায় নামে এক চা বাগান মালিককে। নিঃসন্তান ওই ব্যক্তি ২০০৮ সালে জমিটি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে দেন। কিন্তু টুকরা সিংহের আশ্রয়ে থাকা বিদ্যেশ্বরী দেবীর নাতি বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কর্মীদের সাহায্যে ওই জমির দলিল নিজের নামে করে নিয়েছিলেন প্রদীপ।

জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ির এক প্রোমোটার দীর্ঘদিন ধরে ওই জমিটি কেনার চেষ্টা করছিলেন। সুবিধে করতে না-পেরে সেবক রোড ও ইস্টার্ন বাইপাস এলাকার চার জন জমি মাফিয়াকে কাজে নামানো হয়। তাঁরাই প্রদীপকে খুঁজে বার করেন। এর পরে প্রদীপকে সামনে রেখে প্রথমে আদালতে মামলা এবং তাতেও সুবিধে করতে না-পেরে স্থানীয় কিছু মস্তানকে আশ্রমে হামলায় নামিয়ে দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ করলে প্রদীপ-সহ হামলাকারীরা গ্রেপ্তার হয়।

কিন্তু মূল মাথা যে প্রোমোটার কিংবা মদতদাতা চার মাফিয়া, তাদের গায়ে হাত পড়েনি এখনও। জমি মাফিয়াদের সিন্ডিকেটের হাত কতটা লম্বা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বন দপ্তরের আধিকারিকেরা। শহর শিলিগুড়িকে ঘিরে রয়েছে বৈকুণ্ঠপুর ও মহানন্দা বনাঞ্চল। বাম আমল থেকেই বৈকুণ্ঠপুরে জমি দখল শুরু হয়। এখন ওই বনাঞ্চলের চারটি রেঞ্জ মিলিয়ে শতাধিক হেক্টর জমি মাফিয়াদের হাতে। সেই জমিতে বসতি তৈরি হয়েছে।

বন দপ্তর জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জের ভূমি দপ্তরকে যৌথ সমীক্ষার অনুরোধ করলেও সাড়া মেলেনি। একই ঘটনা মহানন্দা অভয়ারণ্য ঘিরেও। চম্পাসারি এলাকায় দু’টি বনবস্তি খইরানি ও পুন্ডিংয়ে বহুতলের পাশাপাশি রেস্তোরাঁ তৈরি হচ্ছে। বন দপ্তরের পরিকল্পনা বিভাগ সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে সমস্ত বনাঞ্চলের স্যাটেলাইট ম্যাপিং করে।

কিন্তু স্যাটেলাইট ম্যাপিংয়ে কেবল বন বিভাগের দখলে থাকা জমিরই ম্যাপিং হয়েছে। যে সমস্ত জমি বেদখল হয়ে গিয়েছে, তার পুনরুদ্ধারে কী হবে সেটা জানা নেই কারও। উত্তরবঙ্গের অতিরিক্ত প্রধান মুখ্য বনপাল রাজেশ কুমার বলেছেন, ‘গোটা রাজ্যেই স্যাটেলাইট ম্যাপিং হয়েছে। বাকিটাও পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে এগোনো হবে।’

২০১৭ সালে জেলা গঠন হওয়ার পর জমি মাফিয়াদের রমরমা শুরু হয় ঝাড়গ্রামে। গত ছ’বছরে জেলা সদরে জমির দাম বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। ফলে মাফিয়াদের নজরে পড়েছে বনদপ্তরের জমি। ভাস্করকাটা এলাকায় বন দপ্তরের জমি দখল করে ঘর-বাড়ি তৈরি হয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহর লাগোয়া বনদপ্তরের গবেষণা বিভাগের ২৫ হেক্টর জমি এবং শ্রীরামপুরে বনদপ্তরের ৪০ হেক্টর জমির গাছ কেটে দখল করে পাকা ঘর তৈরি হয়েছে।

জমির তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করতে আট দফা নির্দেশিকা জারি নবান্নের

ঝাড়গ্রামের ডিএফও পঙ্কজ সূর্যবংশী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলার পরেই আমাদের গ্রাউন্ড ফিল্ডে তদন্ত চলছে। বনদপ্তরের জায়গা অনেকে দখল করেছে। চিহ্নিত করে রিমুভ করা হবে।’ কীভাবে বনাঞ্চলের জমির চরিত্র বদল করা হয়? ঝাড়গ্রামের এক বনকর্মী বলেন, ‘ভূমি সংস্কার দপ্তরের কথা অমৃত সমান। যত কম বলা যায় তত ভালো।’

কেন? তিনি বলেন, ‘বনাঞ্চলের জমির ক্ষেত্রে দেখানো হয় দখলদার কয়েক দশক ধরে ফাঁকা পতিত জমিতে বসবাস করছেন। তার পরে মিউটেশন। এই কাজে ভূমি দপ্তরের কর্মীদের একাংশ অর্থের বিনিময়ে মাফিয়াদের সাহায্য করেন।’ অনেক সময় আবার ১০ টাকার কোর্ট পেপারে লিখেই পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা কাঠা প্রতি সরকারি জমি বিক্রি করেছে জমি মাফিয়ারা। যেমনটা হয়েছে মেদিনীপুর শহরেও।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *