সামান্য দুধ ব্যবসায়ী থেকে শহরতলির বেতাজ বাদশা! কলকাতার গা ঘেঁষা আড়িয়াদহে শুধু সমান্তরাল প্রশাসন চালানো নয়, নিজের ক্লাবে প্রায়ই সালিশি সভা বসাত এলাকার ত্রাস জয়ন্ত ওরফে জায়ান্ট সিং। সেই সালিশি সভায় এক তরুণীকে নিগ্রহের ভয়াবহ ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসতেই বেআব্রু হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসনের গাফিলতি। তবে শুধু ওই একটি ভিডিয়োই নয়, আড়িয়াদহের তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবে গিয়ে মঙ্গলবার হাতে এলো হাড় হিম করা আরও কয়েকটি ভিডিয়ো, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানাতে বাধ্য। (কোনও ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি এই সময়)।মঙ্গলবার আড়িয়াদহের ওই এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে একটি কিশোরের উপর নারকীয় অত্যাচারের ছবি। ঘটনাস্থল সেই জায়ান্ট সিংয়ের আড়িয়াদহ তালতলা স্পোর্টিং ক্লাব। ১২ সেকেন্ডের ওই ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, ওই ক্লাবের মধ্যে মেঝেতে শুইয়ে এক কিশোরকে বিবস্ত্র করে তার যৌনাঙ্গ সাঁড়াশি দিয়ে টেনে ধরে আঘাত করছে একদল লোক।
সাঁড়াশি দিয়ে টানতে যাকে দেখা যাচ্ছে সে জয়ন্ত-ঘনিষ্ঠ লাল্টু। আশপাশে দাঁড়িয়ে জয়ন্তর সঙ্গীরা। বাচ্চাটি অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কাকুতি মিনতি করলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়ানো হচ্ছে। একইভাবে আরও একটি ভিডিয়োয় (সেটিরও সত্যতা এই সময় যাচাই করেনি) দেখা যাচ্ছে জয়ন্ত তার শাগরেদ বাপ্পাকে বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ক্লাব লাগোয়া বাজারের মধ্যে।
স্থানীয়রা জানান, ওই ক্লাব এবং লাগোয়া আশপাশের এলাকা-সহ গোটা আড়িয়াদহ অঞ্চলে কার্যত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল জয়ন্ত এবং তার দলবল। শাসক দলের ছত্রছায়ায় এসে বছর সাতেকের মধ্যেই উল্কার গতিতে উত্থান এই জয়ন্ত সিংয়ের। খাটাল থেকে বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করা জয়ন্ত প্রথমে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী পরে প্রোমোটারের তকমা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে গত কয়েক বছরে।
স্থানীয়রা জানান, ৭০ থেকে ৮০ জন শাগরেদ সবসময় তার আশেপাশে ঘুরত। এলাকায় বেআইনি নির্মাণ থেকে আড়িয়াদহে রমরমিয়ে চলা শতাধিক মদ, জুয়া এবং সাট্টার ঠেকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এই জয়ন্তের হাতেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, শাসকের মদতেই জয়ন্তর বাড়বাড়ন্ত। অভিযোগ, বিধায়ক মদন মিত্র, তাঁর ছোট ছেলে এবং ছোট বৌমারও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাধে নিজেকে শহরতলির ‘শাহজাহান’ মনে করত জয়ন্ত।
মদন মিত্রের হাত ধরেই রাজনীতিতে প্রবেশ জয়ন্তের। শাসক দলের মিটিং-মিছিলে লোক জোগাড় করা থেকে মানুষকে ভয় দেখানো, ভোটের সময় বিরোধীদের বুথের বাইরে বসতে না দেওয়া সবতেই জয়ন্তের জুড়ি মেলা ভার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, ‘যার সঙ্গে জয়ন্তকে সর্বক্ষণ দেখা যেত সেই বিধায়কের হাত যে তার মাথার উপরে নেই, এটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তো বিধায়কেরই। আড়িয়াদহের একটা বাচ্চাও জানে সবটাই ওই বিধায়কের ছত্রছায়াতেই হচ্ছে।’
স্থানীয়রা বলছেন, ইদানীং মদন অসুস্থ থাকায় জয়ন্ত কিছুদিন চুপচাপ ছিল। কিন্তু মদন সুস্থ হয়ে ফিরতেই আবার আসরে নেমে পড়েছে জয়ন্ত ও তার বাহিনী। গোটা ঘটনায় নিজের দলকে পাশে পাননি মদন। পাল্টা পুলিশকে তোপ দেগে তিনি বলেন, ‘পুলিশ পারে না এমন কোনও কাজ নেই। পুলিশকে বলব ব্যবস্থা নিতে।’ তবে বিরোধীরা এই ঘটনায় তীব্র আক্রমণ শানিয়েছে।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য সায়নদীপ মিত্র বলেন, ‘গত লোকসভা ভোটেও বুথে বুথে জয়ন্তর নেতৃত্বে বাহিনী টহল দিয়েছে। মদন মিত্রের ছত্রছায়াতেই জয়ন্তের এত বাড়বাড়ন্ত।’ বিজেপির রাজ্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্র বলেন, ‘শেখ শাহজাহানের আর এক রূপ জয়ন্ত। শুধু মদন মিত্র নন, পুলিশের আশীর্বাদে জয়ন্ত বাহিনীর অত্যাচারের নৃশংসতা তালিবানি শাসনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।’