জানা গিয়েছে, মূলত সিগন্যাল-ব্যবস্থার সমস্যাতেই সেদিন দুর্ঘটনা ঘটে। তবে রিপোর্টের সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, সেদিনই যে প্রথম ওই লাইনে সিগন্যালে সমস্যা হয়েছিল, এমন নয়। ২০২৩-এর জানুয়ারি থেকে ২০২৪-এর জুন- দেড় বছরে কাটিহার ডিভিশনে মোট ২৭৫টি সিগন্যাল বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ, মাসে গড়ে ১৫টিরও বেশি! প্রতি দু’দিনে একবার। তাই চিফ কমিশনারের মনে হয়েছে, ওই ডিভিশনে যে কোনও রকমের দুর্ঘটনা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
১৭ জুন নিউ জলপাইগুড়ির কাছে রাঙাপানি এবং চটেরহাট স্টেশনের মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে ধাক্কা মারে একটি মালগাড়ি। সেই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের ভার পড়ে কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি-র (সিআরএস) ওপর। সেই রিপোর্টেই দায়ী করা হয়েছে ভারতীয় রেলের অব্যবস্থাকে।
১৭ জুন ২০২৪। সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে পিছন দিক থেকে ধাক্কা মারে পণ্যবাহী ট্রেন। দুর্ঘটনার চার ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার দূরে রাজধানীর রেল ভবনে বসে ভারতীয় রেলবোর্ডের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, ‘চালকের ভুলেই দুর্ঘটনা।’ দুর্ঘটনায় মৃত মালগাড়ির চালক অনিল কুমার সিগন্যাল অমান্য করে অনুমোদিত গতির চেয়ে অনেক বেশি গতিতে এগোচ্ছিলেন, এমনটাই প্রচার শুরু হয় রেলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।
রেলবোর্ডের চেয়ারম্যানের এমন ঘোষণার পরেই অবশ্য দুর্ঘটনার ‘প্রকৃত’ কারণ জানতে তদন্তভার তুলে দেওয়া হয় সিআরএস-এর হাতে। চিফ কমিশনার জনককুমার গর্গ নিজে কারণ অনুসন্ধানে আসেন। তাঁর জমা দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টেই স্পষ্ট হয়েছে চালকের গাফিলতি নয় বরং রেলের উদাসীনতাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
চালকের ভূমিকা
সিআরএস রিপোর্ট জানাচ্ছে, দুর্ঘটনাস্থল অর্থাৎ রাঙাপানি ও চটেরহাট স্টেশনের মাঝে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি কত হতে পারে, সে বিষয়ে চালকের কাছে কোনও নির্দেশ ছিল না। ওই অংশে ট্রেন ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। মালগাড়িটি চলছিল ৭৮ কিমি/ঘণ্টা গতিতে। একই লাইনে কিছু দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিল কুমার ইমার্জেন্সি ব্রেক প্রয়োগ করেন।
কিন্তু ব্রেক ধরেনি। শেষ পর্যন্ত ৪০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে মালগাড়ি ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। আদতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরেই সেই লাইন দিয়ে মালগাড়ির যাওয়ার কথা ছিল। দুর্ঘটনার জন্য মালগাড়ির চালককে দায়ী করেননি চিফ কমিশনার। জানিয়েছেন, চালক ‘সতর্কই ছিলেন।’
ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণ
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ি- দু’টির কোনওটিরই রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি রিপোর্টে। কমিশনার জানিয়েছেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের রেকটি যাত্রী পরিবহণ শুরু করে ২৮ মার্চ ২০১৩ থেকে। সূচি মেনেই তার রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছিল ১৯ এপ্রিল ২০২৪-এ। দুর্ঘটনার মাত্র চার দিন আগে ১৩ জুন ২০২৪-এ আরও একবার রক্ষণাবেক্ষণ হয়। রেকের কোনও ওভারহলিংই বাদ ছিল না। অন্য দিকে মালগাড়িটি কাজ শুরু করেছিল ২০২৪-এর ১০ মার্চ- দুর্ঘটনার মাত্র তিন মাস আগে। ট্রেনটি একেবারেই নতুন বলা যায়।
অটোম্যাটিক সিগন্যাল সমস্যা
দুর্ঘটনার আগে যে কাটিহার ডিভিশনের ওই লাইনে অটোম্যাটিক সিগন্যাল-ব্যবস্থায় যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল, সেটা দুর্ঘটনার পরেই প্রকাশ পেয়েছিল। চিফ কমিশনারের রিপোর্টেও তার উল্লেখ রয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, সোমবার ১৭ জুন সকাল ৫টা ৫২ মিনিটে ওই লাইনের সিগন্যাল-ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায়। তার প্রায় তিন ঘণ্টা পরে দুর্ঘটনা ঘটে। ওই তিন ঘণ্টায় চেষ্টা করেও সিগন্যালের গোলমাল সারানো যায়নি।
যে যেমন পেরেছেন, গিয়েছেন
রিপোর্টে জনককুমার গর্গ লিখেছেন, অটোম্যাটিক সিগন্যাল বিকল হওয়ার পর এবং দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত রাঙাপানি ও চটেরহাটের মধ্যে দিয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত মালগাড়ি-সহ মোট সাতটি ট্রেন গিয়েছিল। স্পিডোমিটার ও ডেটালগারের মতো বিভিন্ন যন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, এক একটি ট্রেন এক একটি সিগন্যাল পোস্ট এক-একরকম গতিতে পার করেছিল। অর্থাৎ, কোনও ট্রেনের চালকের কাছেই সর্বোচ্চ কত গতিতে ট্রেন চলতে পারে, সেই সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল না।
অব্যবস্থা চরমে
দুর্ঘটনার পর ডিভিশন স্তরের কন্ট্রোল অফিসে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গিয়েছে একটা শিফটে একজন সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার, একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র এবং একজন সহকারীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সেখানে দুর্ঘটনার সময়ে মাত্র একজন টেকনিশিয়ান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও সিআরএস অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, গোটা কাটিহার ডিভিশনে রেলকর্মীদের যোগাযোগ রক্ষার জন্য অন্তত ৭৩২টি ওয়াকিটকির প্রয়োজন থাকলেও রয়েছে মাত্র ৩০৩টি।
এই পর্যবেক্ষণের পর চিফ কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটির সিদ্ধান্ত, ট্রেন পরিচালন-ব্যবস্থায় সর্বস্তরের ত্রুটির জন্যই ১৭ জুন দুর্ঘটনায় পড়েছিল কাঞ্চজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার পর রেলকর্মীদের সংগঠন অল ইন্ডিয়া রেলওয়েমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে সহকারী সাধারণ সম্পাদক অমিত ঘোষ বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর থেকেই চেষ্টা চলেছিল চালককে দোষী প্রমাণের। আমরা তখনই বলেছিলাম, সিআরএস তদন্তে সবটা স্পষ্ট হবে। হলোও তা-ই।’