তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ভুলে আপাতত পড়াশোনা এবং কেরিয়ারেই নজর দিতে চান যাদবপুরের মেন হস্টেলে নির্যাতিত এমটেকের ওই ছাত্র। পরিবার, বাবার স্বাস্থ্য ও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কোনও অভিযোগও করতে চান না। মেন হস্টেলের ঘটনাকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হিসেবেই তুলে ধরতে চান তিনি। তবু কিছু কথা বলার আছে সেই ছাত্র বিশ্বজিৎ প্রামাণিকের।যাদবপুরের মেন হস্টেলে ‘মব জাস্টিস’ (একসঙ্গে অনেকে ঘিরে ধরে বিচার)-এর কালচার নিয়ে তাঁর প্রবল আপত্তি। ঘটনার রাতে যে ভাবে তাঁকে বেশ কিছু ছেলে চুরির অপবাদে ঘিরে ধরেছিল, মুচলেকা লিখতে বলা হচ্ছিল, সে সব দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। বিশ্বজিতের কথায়, ‘ভুল করেও কাউকে ঘিরে ধরে চোর অপবাদ দেওয়া যায় না। তার উপর মুচলেকা লিখতে বলা হচ্ছিল। চাপটা নিতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। সেটা হয়তো আমারই ব্যর্থতা। খুব ভয় পেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সুপার ম্যামকে ধন্যবাদ। তিনি ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলেন বলে আমি আরও অসুস্থ হয়ে যাইনি।’
বিশ্বজিৎ আদতে পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির বাসিন্দা। পড়েন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সান্ধ্য বিভাগে। আজ, সোমবার থেকে ক্লাস থাকলেও এই সপ্তাহটা ইউনিভার্সিটি যাবেন না। মেন হস্টেলের ডি ব্লকের সেই রুমে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। অন্য কোথাও, যেখানে নবাগতদের সংখ্যা বেশি, তেমন হস্টেলেই থাকতে চান। সে জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাও বলবেন।
কী হয়েছিল সে রাতে? পড়ুয়ার কথায়, ‘কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম যে, আমার রুমমেটের ল্যাপটপ চুরি হয়ে গিয়েছে। ঘটনার দিন, অর্থাৎ গত বুধবার রাতে একদল ছাত্র আমাকে ঘিরে ধরে চুরি নিয়ে চাপ দিতে থাকে। দেখলাম, মুহূর্তের মধ্যে অনেক ছাত্র জুটে গেল। এত জন মিলে ঘিরে ধরায় আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘এত ছেলে যে কী ভাবে চলে এল, কী করেই বা আচমকা জানা গেল যে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া গিয়েছে, তা বুঝতে পারছি না।’
নেপথ্যে ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না বিশ্বজিতের। তবে জমায়েতের কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিক্যাল সুপার মিতালি দেব ঘটনাস্থলে পৌঁছনোয় আশ্বস্ত বোধ করেন তিনি। না হলে যে কী ঘটে যেত, সেটা ভেবেও আতঙ্কিত হন ওই ছাত্র।
এখানে অবশ্য বিষয়টা থামেনি। তিনি হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীনও একদল ছেলেমেয়ে তাঁকে ‘ল্যাপটপ চোর’ হিসেবে ক্যাম্পাসে দাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। এখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হচ্ছে অপবাদ। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের আচার-আচরণ বিবেচনা করে দেখার অনুরোধ বিশ্বজিতের। তাঁর কথায়, ‘আমার বাবা ছোট একটা মুদিখানার দোকান চালান। আমার আর বোনের পড়াশোনার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কোডিং ভালোবাসতাম। তাই ২০১৬ সালে বাবা ধারদেনা করে একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন। সেটাই ব্যবহার করি।’
তা হলে তিনি কেন চুরি করবেন, প্রশ্ন তুলছেন বিশ্বজিৎ। তাঁর বক্তব্য, ‘কে চোর বলল, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। বাবা মা বোন বন্ধুরা জানে, আমি জানি, যে আমি চোর নই। এতেই খুশি।’
বিশ্বজিৎ ঠিক এক বছর আগে মেন হস্টেলের নাম শুনেছিলেন। তখন নদিয়ার এক ছাত্র র্যাগিংয়ের জেরে মারা যায়। কিন্তু বিশ্বজিৎ সেই সময়ে যাদবপুরে ভর্তি হননি। মাস ছয়েক আগে মেন হস্টেলের আবাসিক হয়েছেন। এই ছ’মাসে তাঁর দু’টি উপলব্ধি — প্রথমত, সিনিয়র ও জুনিয়র বোর্ডারদের সেখানে একসঙ্গে রাখা ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, মেন হস্টেলের কিছু আবাসিক এ সবে যুক্ত, সবাই নন। তাঁর কথায়, ‘আমি রাজনীতি করি না। মেন হস্টেলের কথা উঠলেই অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু আমরা সবাই এমন নই।’
সে দিনের ঘটনার রেশ কাটতে যে সময় লাগবে, তা জানেন বিশ্বজিৎ। তবু অভিযোগ দায়ের করছেন না কেন? বিশ্বজিতের জবাব, ‘আমি চাই, এটা এখানেই মিটে যাক। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। বাবার হার্টের অসুখ। আমিও পাশ করে একটা চাকরি নিয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ সব শেষে বলছেন, ‘আমি কমরেড হতে যাদবপুরে আসিনি। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার স্টার হতে চাই না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন প্লিজ়।’