Rg Kar Incident,মাঝরাতে ঢল বাংলার পথে, মেয়েদের সঙ্গী পুরুষ-শিশুও – demand for justice rg kar incident woman protest on wednesday midnight in kolkata also villages


এই সময়: রাতের দখল নিল মেয়েরা। বুধবার মাঝরাতে যে ঢল নামলো কলকাতা ছাড়িয়ে মফঃস্বলে, মফঃস্বল ছাড়িয়ে গ্রামে, তার সাক্ষী হয়ে রইল প্রাক স্বাধীনতা দিবসের রাত। তরুণী-চিকিৎসকের খুনের ঘটনার বিচারের দাবিতে এত মানুষ যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নামবেন, সম্ভবত তা আন্দোলনরত চিকিৎসকরাও আঁচ করতে পারেননি। অনেকেই এর সঙ্গে তুলনা টানছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ডাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের প্রসঙ্গ-ও।ঘড়ির কাঁটা তখন মধ্যরাতের গণ্ডি পেরিয়েছে। যাদবপুর এইটবির সামনে কোলে ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে শিউলি চৌধুরী। পাশে তাঁর স্বামী অনিমেষও। ঘুমিয়ে পড়া শিশুর জন্য মায়ের বুকে যে চিন্তা, তার চেয়েও বড় ভাবনা যেন সেই মেয়েটির জন্য। যাঁকে নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছে মাত্র কয়েকদিন আগে। আরজি করে ঘটে যাওয়া সেই মর্মান্তিক পরিণতির বিচার চাইতেই সুভাষগ্রাম থেকে এইটবি ছুটে এসেছিলেন ওই দম্পতি।

ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে না তো? মা বলছেন, ‘হবে না! দুষ্টু লোকেদের শাস্তি চাই বলে স্লোগান দিতে দিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।’
শুধু তো কোলের শিশু নয়, কেউ এসেছেন বাড়ির প্রিয় পোষ্য নিয়ে, কেউ আবার হুইল চেয়ারে চেপে। লাঠি হাতে যেমন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা পা মিলিয়েছেন মিছিলে, তেমনই তাঁর গা-ঘেঁষে হাঁটতে দেখা গিয়েছে ১৮-র তরুণীকেও।

হাতে হাত মিলিয়ে অনেকে এসেছেন বন্ধুকেও সঙ্গে নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে একের পর এক জমায়েতের ভিডিয়ো এবং ছবিও। মনে হয়নি রাত। মনে হয়নি, এটা বিশ্রামের সময়। বাড়ি-ঘর, হেঁসেল-রান্না ছেড়ে মানুষ নেমে পড়েন পিচ রাস্তায়। অত রাতে হাততালি দিতে দিতে স্লোগান দিয়েছেন, গান গেয়েছেন, কবিতা পড়েছেন।

অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আটর্সের সামনে ৭০ পেরিয়ে যাওয়া গীতা দে এসেছিলেন। সঙ্গে ৭৫ বছরের স্বামী সনৎ। যিনি হাঁটাচলা করেন ওয়াকারে। আজীবন নার্স হিসেবে রোগীর সেবা করে গিয়েছেন গীতা। জমায়েতে হাজির হয়েছিলেন বিচার চাইতে। সঙ্গে ফার্স্ট এইড বক্স। যদি এই কেউ আহত হন, বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, সে কথা মাথায় রেখে।

পাইকপাড়া থেকে কলেজ স্ট্রিটে এসেছিলেন ৭৮ বছরের অন্তরা চৌধুরী। বিকাশ ভবনের ওই প্রাক্তন কর্মীর সঙ্গে এসেছেন তাঁর দুই নাতনি দিয়া এবং বীথি। দিয়া পড়ে ক্লাস সেভেনে। বীথি এ বছরই যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। দিয়া, বীথি আর অন্তরা— সব প্রজন্মই চায় বিচার। চায়, এই শহরের বুকে মেয়েদের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। তা সে রাতই হোক বা দিন।

শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের জমায়েত থেকে স্লোগান তুলছেন একসঙ্গে মা, মেয়ে ও পুত্রবধূ। রাতের দখল নিতে তাঁরা অবশ্য বেশি দূর নয়, এসেছিলেন বাগবাজার থেকে। মা হৈমন্তী দাস, মেয়ে শকুন্তলা এবং পূত্রবধূ অনামিকা দাসরা কী চান? উত্তর আসে, ‘স্বাধীনতা…।’ কীসের স্বাধীনতা? অনামিকার উত্তর, ‘মেয়েদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা পথে নেমেছি। কেন স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও স্বাধীন নই বলতে পারেন? কেন নিরাপদ নয় মেয়েরা?’

জমায়েতের জেরে এক সময়ে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে শ্যামবাজারও। সাধারণ ঘরের অসংখ্য মহিলারা বাচ্চা কোলে, হেঁটে রওনা দেন মিছিলে সামিল হতে। এই খণ্ডচিত্রগুলোই ছিল স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্‌কালে মধ্যরাতের সার্বিক ছবি। শহরের রাজপথ ছাড়িয়ে জেলা, জেলা থেকে ভিন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ। দিল্লি, পুণে, বেঙ্গালুরু, মুম্বই- এ ক্ষেত্রেও তালিকাটি দীর্ঘ।

আবার দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে লন্ডন, ইউএসএ, আমস্টারডাম— সেখানেও রাতের দখল নিয়েছিলেন মেয়েরা। সেই রাতের বিভীষিকা কাটিয়ে রাতকে-ই যেন এ দিন কয়েকঘণ্টার জন্য দখল করে নিয়েছিল অর্ধেক আকাশ। যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন ছেলেরাও। এমনকী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনও। কলকাতা থেকে কাকদ্বীপ সর্বত্র জমায়েতে হাজির হওয়া মহিলাদের হাতে ছিল দেশের পতাকাও।

যদিও এই রাত দখলের ডাক ছিল ছোট্ট একটা স্ফুলিঙ্গ। কয়েক দিন আগেও যা ছিল নিছক জনাকয়েক পরিচিতের জমায়েতের ডাক, শেষ পর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় দেশের জনতার মুক্ত চিন্তা ও প্রতিবাদের কণ্ঠ। অর্ধেক আকাশের কাব্যিক ব্যঞ্জনার গণ্ডি টপকে রাত-পথের দখলের ডাক দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী রিমঝিম সিনহা। তাঁর সেই ডাক মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় নেট পাড়ায়। তার আর পর রইল না।

পাহাড় থেকে সাগর— স্বাধীনতার রাতকে নিজেদের করে নিতে পথে নেমে পড়েন মেয়েরা। দল-মত-রাজনৈতিক মতাদর্শ সরিয়ে রেখে মধ্যরাতের ডাকে সন্ধ্যা থেকেই পথে নেমে আসেন দলে দলে। হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি, মুখে প্রতিবাদী গান-কবিতা। বুধবার যেন এক অন্য রাতের সাক্ষী রইল গোটা বাংলা।

যাদবপুর, বেহালা, কলেজ স্ট্রিট, অ্যাকাডেমি চত্বর থেকে শুরু করে শ্যামবাজার মোড়, নিউটাউনের বিশ্ববাংলা গেট- সর্বত্রই সন্ধ্যা থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেন মহিলারা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে শুরু করে সেখানে। শুধু তো এই ক’টি জায়গা নয়। তিলোত্তমার আনাচ-কানাচে জমে উঠেছিল ভিড়। কলকাতার প্রায় প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি প্রধান মোড়ে দেখা যায় জটলা। এত এলাকার নাম লেখা সম্ভবও নয়।

অন্যদিন, রাত ১২টার পরে শহর প্রায় ঝিমিয়ে পড়ে, অথচ এ দিনের ছবি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মাঝে টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হলেও ময়দান ছেড়ে যাননি কেউ-ই। সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ, আট থেকে আশি, সব শ্রেণি, সব পেশার মানুষেরাই জড়ো হয়েছিলেন এ দিনের ডাকে। সোদপুরের এক অটোচালক এ দিন দুপুরেই সমাজমাধ্যমে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে পোস্ট করেন, ‘রাতে গাড়ি না পেলে আমাকে ফোন করবেন। কোনও ভাড়া লাগবে না। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেব।’

মেয়েদের দখলে রাতের রাজপথ, আরজি করকাণ্ডের প্রতিবাদে গর্জে উঠল বাংলা

রাতের সব মিছিলে মূল স্লোগান, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ হলেও শুরু থেকেই বহু জায়গায় প্রতিবাদীরা ছিলেন সচেতন। রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং অযৌক্তিক দাবি তোলার বিরুদ্ধে তাঁরা যেন ছিলেন প্রহরীর মতো-ই। অ্যাকাডেমিতে যেমন ঘোষণা করা হয়, কোনও পুরুষ মঞ্চে স্বাগত নয়। আবার প্রতিবাদীদের চাপে যাদবপুরে লাল পতাকা নামিয়ে নিতে বাধ্য হয় একদল জনতা।

এরই মধ্যে ঘটে যায় কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনাও। লেকটাউনে অভিযোগ ওঠে, প্রতিবাদীদের বাধা দিয়েছে পুলিশ। হাওড়ার মন্দিরবাজারে তৃণমূলের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগও উঠেছে। যদিও এই বিচ্ছিন্নতা উপড়ে দিয়ে মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন প্রমাণ করতে চেয়েছে, এই রাত কেবল মেয়েদের নয়, সকলের।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *