ড্রাই হয়ে গিয়েছিল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। সেখান থেকেই বাড়ির ট্যাক্স, ইলেকট্রিসিটি বিল কাটা হতো। অ্যাকাউন্ট হোল্ডারকে সশরীরে রিমাইন্ডার দিতে গিয়ে ব্যাঙ্কের অফিসার দেখেন, গ্যারাজে গাড়ির সিটে বসে বাড়ির মালকিন। প্রাণের স্পন্দন নেই। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, মৃত অবস্থায় ওই মহিলা নাকি দীর্ঘ ৬ বছর ও ভাবেই ছিলেন!২০১৩ সালে আমেরিকার ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা এক প্রদেশের এমন মর্মান্তিক ঘটনার কথা জানা যায় সিএনএন-এ। উঠে আসে প্রথম বিশ্বের অন্ধকার এক দিক। দীর্ঘ ৬ বছর সেই একাকী বৃদ্ধাকে দেখতে না-পেয়ে খোঁজ করেননি কেউই। পাশের বাড়ির মানুষটাও না।অদ্ভুত লেগেছিলো খবরটা – খুব শকিং। ঠিক করেছিলাম, এটাকে তুলে ধরতে হবে।
সিএনএন-এর দেখানো সেই সত্য ঘটনার অবলম্বনে আমার তৈরি শর্ট ফিল্ম ‘ক্যানভাস’ অনেকগুলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ দেখানো হয়। ক্যানভাস ছিল আমার মাস্টার্স-এর থিসিস ফিল্ম। ২০১৮-তে নন্দনেও সেটা দেখানো হয়েছিল। এর পর পরপর দু’বছর আরও দু’টি শর্ট ফিল্ম করি। কলকাতা চলচিত্র উৎসবে দেখানো হয় সেগুলোও।
এখন তো শর্ট ফিল্মের পাশাপাশি ফুল লেংথ ফিচার ফিল্মও বানাতে চাই। কিন্তু চাইলেই তো হলো না। রেস্ত চাই। কলকাতা ছেড়ে, আমার শহর ছেড়ে এখন আমি পাকাপাকি ভাবে নিউ জার্সিতে। পুরোদস্তুর সংসারি। গত দু’বছর ধরে এখানে মিডিয়া কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াচ্ছি। অতিরিক্ত সময় বের করাই মুশকিল। কিন্তু প্যাশন ছাড়ি কী করে? শুধু ছবি নয়, প্যাশন কবিতাও।
আমেরিকার এই শহরে বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত চর্চা হয়। তবে আবৃত্তি, বা বাচিক শিল্পটাকে খানিকটা দুয়োরানি হিসেবে দেখা হতো। ঠিক করেছিলাম, এই কালচারটা বদলাতে হবে। আমার কবিতার সঙ্গে অডিয়ো-ভিজ়ুয়াল, মিউজ়িক, নাচ — সব মিলিয়ে স্টেজ করি। আমার টিম আছে। কবিতা নিয়ে আমরা ইউএস, তার বাইরেও অনুষ্ঠান করি।
নিজের মেয়েকে বাংলা শেখানোর জন্য আনন্দ মন্দির স্কুল অফ আর্টসে একটা বাংলা স্কুল খুলেছি। সেখানে আরও অনেক বাচ্চা উইকএন্ডে ক্লাস করতে আসে। আমার মেয়ে এখন ঝরঝরে বাংলা বলে, বাংলা গান-কবিতা ভালোবাসে, এটাই সার্থকতা। এই সব মিলিয়ে ব্যস্ত প্রবাস জীবন।
২০১৭ আর ২০১৮ —পর পর দু’বছর মা ও বাবাকে হারিয়েছি। কোনও পিছুটান নেই সেই হিসেবে। কলকাতায় ফ্ল্যাট আছে। বন্ধু আছে। আর আছে ফেলে আসা অগুণতি স্মৃতি। সিঁথির একটি স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ। জীবনের সেই গতিপথ বদলে গিয়েছিল এক ঝটকায়। ১৯৯৮ সালে খাসখবরে মিডিয়া জীবনের শুরু, যার সঙ্গে অর্থনীতির যোগটা ছিল শুধুই মাস মাইনেতেই।
তবে মিডিয়া আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ফিরে তাকাতে হয়নি কখনও। কলকাতায় বহু নিউজ় চ্যানেলে অ্যাঙ্কার, নিউজ় রিডারের কাজ করেছি। খবরের কাগজেও চাকরি করেছি। কলকাতায় কাজ করতে করতেই ক্যামেরার সঙ্গে পরিচয়। এখন নিজের ছবির ক্যামেরা নিজেই চালাতে পারি।
পিনাকির সঙ্গে বিয়েটাও বেশ সিনেমার মতোই। ২০১০-এ আমেরিকায় এনএবিসি-তে এসে ওর সঙ্গে আলাপ। আমেরিকাতেই ওর পড়াশোনা ও চাকরিজীবন শুরু। আদ্যন্ত বাঙালি। সে বার খুব আড্ডা হয়। সেই বছরের শেষে লন্ডনে আরেকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, ওখানে এসে ও প্রোপোজ় করে। ২০১১-তে বিয়ে। ঠিক করেছিলাম পটের বিবি সেজে আমেরিকা যাব না। নিজে কিছু করব।
তাই বিয়ের পরে পিনাকি চলে গেলেও আমি কলকাতায় বসে নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করি। তার জন্য এক বছর ধরে প্রস্তুতি চলে। মিডিয়া কমিউনিকেশন নিয়ে মাস্টার্সের সুযোগ পেয়ে চলে যাই নিউ জার্সি। ২০১৬-তে ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে নমিনেট করে। আমি ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ফিল্ম ও টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ড পাই। ওদের স্কলারশিপে আমার প্রথম ছবি বানিয়েছিলাম।
এর আগেও একটা বড় প্রাইজ় এসেছিল জীবনে। ২০১৪ সালে। আমার মেয়ে। পিনাকি, মেয়ে, শাশুড়ি নিয়ে এখন সংসার। তবু কলকাতা আমাকে সারাক্ষণ টানে। ক’দিন আগেই ঘুরে এলাম। ওখানে সুন্দরবন ঘুরে একটা ডকুর কাজ করছিলাম। আবার ফিরেছি ব্যস্ত প্রবাস জীবনে। তাকিয়ে রয়েছি, কবে একটু সুযোগ পেলেই উঠে পড়ব কলকাতার ফ্লাইটে।

 
                    