এই চক্রের বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ তুলে বদলির কোপে পড়েছিলেন আরজি করের ডেপুটি সুপার আখতার আলি। ঘটনাচক্রে, হাইকোর্টে তাঁরই দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে এই দুর্নীতির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেয় আদালত। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পরে সোমবার সন্ধ্যায় সন্দীপের সঙ্গে তাঁর এই তিন শাগরেদকেও গ্রেপ্তার করে সিবিআই। আখতারের কথায়, ‘তিন জন আরজি করের কেউ না হলেও সকলের সঙ্গেই হাসপাতালের অনৈতিক ব্যবসার সম্পর্ক।’
তিনি জানান, সন্দীপের প্ল্যানে হাসপাতালের সব টেন্ডারকে ভেঙে ১ লক্ষ টাকার কম মূল্যের অনেকগুলি টেন্ডারে ভাগ করা হতো। এর পর সেই টেন্ডারগুলি পেয়ে যেতেন এই তিন জন-ই।
অথচ স্বাস্থ্যভবন কিংবা কলেজ কাউন্সিল, কেউ এ সব সিদ্ধান্তের কথা ঘুণাক্ষরে জানতে পারতেন না। সন্দীপের ঘনিষ্ঠরাই পেয়ে যেতেন একের পর এক ফুড স্টল, সুলভ শৌচালয়, ক্যাফে, ক্যান্টিন, পার্কিংল লট ইত্যাদি চালানোর বরাত। যেমন, সন্দীপের অতিরিক্ত নিরাপত্তা রক্ষী আফসার। বেলগাছিয়ার ওই বাসিন্দা তাঁর ঘনিষ্ঠদের নামে ঈশান ক্যাফে-সহ একাধিক কোম্পানি খোলেন।
আরজি কর চত্বরে ক্যাফেটি চালান আফসারের স্ত্রী। আর হাসপাতালের টু-হুইলার পার্কিং লট চালান তাঁর ভাই। এই রক্ষীর দাপট এতটাই মাত্রাছাড়া ছিল যে, বর্তমান অধ্যক্ষ মানস বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর অগস্টে দু’দিনের জন্য যখন দায়িত্ব নিতে এসেছিলেন, তখন তিনিও আফসারের চরম দুর্বিনীত আচরণ থেকে রেহাই পাননি।
আবার হাওড়ার সাঁকরাইলের বাসিন্দা সুমন ও বিপ্লবের ছিল যথাক্রমে হাজরা মেডিক্যাল এবং তারামা ট্রেডার্স নামে দু’টি সংস্থা। আরজি করের প্রয়োজনীয় যাবতীয় ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তো বটেই, স্টেশনারি সামগ্রী, জল থেকে স্যালাইনের বোতল, ট্যাবলেট-ইঞ্জেকশন থেকে শুরু করে ফাইল কিংবা প্রিন্টিং মেটেরিয়াল, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি—সবই বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ দামে বিলিং করা হতো হাসপাতালকে সরবরাহের নাম করে।
এমনকী, পূর্ত দপ্তরের সিভিল ও ইলেকট্রিক্যাল কাজকর্মের বরাতও পেয়ে যেত সুমন আর বিপ্লবের সংস্থা। অতিমারীর সময়ে কোভিড ফান্ডের টাকায় এঁদের দিয়েই হাসপাতালের সোফা, আসবাব, ফ্রিজ ইত্যাদি কেনা হয়। তদন্তকারীরা একপ্রকার নিশ্চিত, এই সব কিছুরই নিয়মিত কমিশন পেতেন সন্দীপ।
কিছুদিন আগেই হাওড়ার সাঁকরাইলে এক অনুষ্ঠানে বিপ্লব ও সুমনকে তৃণমূলের হাওড়া সদরের সভাপতি কল্যাণ ঘোষের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে দেখা যায়। বিজেপি সেই ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। যদিও কল্যাণের দাবি, ‘একটি অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে যারা ছিল তাঁদের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। কাউকে চিনিও না।’ তৃণমূলের হাওড়া জেলা পরিষদের সদস্য তুষার ঘোষ বলেন, ‘২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপ্লব সিপিএমের প্রার্থী ছিল। সুমনের আন্দুলে ওষুধের দোকান আছে। দু’জনের এলাকায় কোনও বদনাম ছিল না।’
এদিকে, স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বিপ্লব সিংহ আগে ছবি আঁকার কাজ করলেও পরে সুমন হাজরার সঙ্গে ওষুধের ব্যবসায় যোগ দেন। সন্দীপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরে তাঁদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে বলে অভিযোগ। দুজনেই কলকাতার আরজি কর হাসপাতাল-সহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ওষুধ এবং চিকিৎসার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতেন।