Child Marriage,ঘূর্ণিপাক কাটিয়ে উজ্জ্বল বহ্নিশিখা, পাচার-বাল্যবিবাহ-গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়েও জীবন-স্রোতে – south 24 parganas woman returned to normal life despite being a victim of trafficking child marriage and domestic violence


এক মনে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন বছর ২৪-এর তরুণী। চাকরির পরীক্ষা। এমন সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি ব্লকের বিডিও এলেন সেন্টার পরিদর্শনে। চোখ আটকে গেল ‘বহ্নি’র (নাম পরিবর্তিত) দিকে। উঠে দাঁড়াতে বললেন তাঁকে। অন্য পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে বললেন, ‘এই প্রত্যন্ত গ্রামেও সাহস আর ইচ্ছাশক্তির আগুন ছড়িয়ে বহ্নি যে অবস্থায় পরীক্ষা দিচ্ছেন, তা হয়তো বহু মেয়ে ভাবতেও পারবে না।’ সকলে ঘুরে তাকায় সাহসিনীর দিকে। লাজুক হাসি ছড়িয়ে পরে তরুণী মায়ের মুখে।কেন বহ্নিকে নিয়ে এতটা গর্বিত বিডিও?
ফিরতে হবে বছর সাতেক আগে। স্কুলে পড়তে পড়তে ১৭ বছর বয়সে পড়শি এক মহিলার পাল্লায় পড়ে সে পাচার হয়ে গিয়েছিল। মাস কয়েকের মধ্যে ফিরে আসে। তার পর যা হয়। মা-বাবা মেয়েকে ফিরিয়ে নিলেও নানা বাঁকা কথা, টিপ্পনি, কটূ কথা, নোংরা ইঙ্গিত করার লোকের অভাব হয়নি। বহ্নির মা চাইতেন মেয়ে পড়াশোনা শেষ করুক। বাবা রাজি হননি। ফের যদি মেয়ে… আশঙ্কায় সম্বন্ধ দেখে বহ্নির বিয়ে দিয়ে দেন।

সে জীবনও সুখের হয়নি সপ্তদশীর। অত্যাচার শুরু করে স্বামী। স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেল করত! প্রতিবাদে জুটত বেধড়ক মার। মা-বাবার কাছে ফিরে এলেও স্বামীর মিষ্টি কথায় ভুলে আবার ফিরে যায় শ্বশুরবাড়িতে। আবারও শুরু হয় অত্যাচার। ক্রমাগত নিগ্রহ ও নোংরামি সহ্য করতে না পেরে বহ্নি একদিন পাকাপাকি ভাবে পালিয়ে আসেন মা-বাবার কাছে। তখন সদ্য তরুণীর কোলে এক সদ্যোজাত কন্যা। পাচারের মামলা তো চলছিলই। গার্হস্থ্য হিংসা ও অশ্লীল ভিডিয়ো নিয়ে নতুন মামলা দায়ের করেন বহ্নি।

এই কঠিন সময়েও সকলকে চমকে দিয়ে, সব প্রতিবন্ধকতাতে দূরে সরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। পাচার-বাল্যবিবাহ-গার্হস্থ্য হিংসা-মাতৃত্ব কোনওটাই তাঁর কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখন কলেজে পড়ছেন আর্টস নিয়ে। পাশাপাশিই বসেছেন চাকরির পরীক্ষায়।

এত মানসিক শক্তি? ‘এই সময়’কে বললেন, ‘মা সব সময়ই পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন। যখন ধরে নিয়েছি আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গিয়েছে – ফের স্কুলে ফেরার কথা বলেছিলেন মা। সেটাই ছিল আমার শক্তি।’ জানালেন, পাচার হয়ে ফেরার পরে একটি এনজিও তাঁকে খুব সাহায্য করেছিল। ট্রমা কাউন্সেলিং ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নয়তো সম্ভব হতো না। ওই সংস্থার উদ্যোগেই চলে ‘বন্ধনমুক্তি’ কমিউনিটি। ট্র্যাফিকিং সারভাইভার যে মেয়ে ও মহিলারা রয়েছেন, তাঁদের একটি সমষ্টি।

ছোট ছোট গ্রুপে তাঁরা গ্রামের দোরে দোরে মানবপাচার-বাল্যবিবাহ-গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে প্রচার করে। চলে সারভাইভারদের ট্রমা কাউন্সেলিং-ও। এ ভাবেই বন্ধনমুক্তির একজন ‘সারভাইভার লিডার’ বহ্নির খোঁজ পান। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ে ধাতস্থ হয়ে ওঠেন বহ্নি। মায়ের কথামতো ফের শুরু হয় পড়াশোনা। বহ্নিও যোগ দিয়েছেন ‘বন্ধনমুক্তিতে’। শিখছেন স্বনির্ভর হওয়ার পাঠ। সেই সূত্রেই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে পরিচয়। সেখানে সদ্যোজাত থেকে ৬ বছর পর্যন্ত শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা আসেন। পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয় তাঁদের। শিশুদের দেওয়া হয় ‘আনন্দপাঠ’।

বহ্নি নিজেই এখন সারভাইভার লিডার। হবু মায়েদের বোঝান – বাল্যবিবাহ ও কিশোরী বয়সে মা হওয়ার বিপদের কথা। নিজেরও উদাহরণ দেন। তাঁর নিজের মেয়ের বয়স চার। তিনি জানেন, শিশু-বয়স থেকেই আত্মরক্ষার পাঠ, গুড টাচ-ব্যাড টাচ বোঝানো জরুরি। আর এই ‘বন্ধনমুক্তি’র মাধ্যমেই বহ্নির সঙ্গে বিডিও-র আলাপ। বিডিও-র কথায়, ‘বহু মেয়ে চাইলেও সামাজিক চাপে ফিরতে পারেন না। বহ্নি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমি চাই ওঁকে দেখে বাকিরাও আত্মশক্তিতে জেগে উঠুক। প্রশাসন পাশে আছে।’

বহ্নি বলছেন, ‘স্যর (বিডিও) ও বন্ধনমুক্তি জীবনের অন্ধকারকে পিছনে ফেলে আলোর ঠিকানা দেখিয়েছেন। মা-বাবা পাশে আছেন।’ অগ্নি-তেজ ছড়িয়ে বহ্নির আত্মপ্রত্যয় – এখন শুধু পাল্টা মারে জবাব দেওয়ার পালা… ‘আমি জিতবই। নিজের জন্য। মেয়ের জন্য। আমার মতো বহু মেয়েদের জন্য।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *