Heart Transplant,৪৭/১ম জন্মদিন লাল্টুর, বিগ ব্যাশ আয়োজনে স্ত্রী – bankura residence laltu dhibar successful heart transplant after 5 years illnesses


প্রশান্ত ঘোষ
লাল্টুর জন্মদিন। তাই ঘটা করে কার্ড ছাপানো হয়েছে।
নিমন্ত্রিত দেড় হাজার।
মেনুতে পদ দু’ডজন!
লাল্টুর কিন্তু এটা প্রথম জন্মদিন নয়। পাঁচ বছর বা দশ বছরের নয়। লাল্টু সবে সাবালক হয়েছে, এমনটাও নয়। লাল্টু আসলে পা রাখলেন ৪৭-এ। আর তিন বসন্ত পার করলেই হাফ সেঞ্চুরি! তা হলে কেন প্রথম বার এমন যজ্ঞবাড়ির আয়োজনে তাঁর জন্মদিন পালন?
উদযাপনটা আসলে লাল্টুর পুনর্জন্মদিনের। তাই প্রথম বার এমন ঘটা! স্ত্রী পম্পার পাঠানো নিমন্ত্রণপত্রেও লেখা, ‘লাল্টু ধীবরের ৪৭/১ম জন্মদিন।’ শুধু আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নয়, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও ডেকেছেন পম্পা।আদতে লাল্টুর জন্মদিন ১০ অক্টোবর। কখনও, কোনও বছরেই সেই দিনে ঘটা করে কিছু করা হয়নি। ২০১৮ থেকে টানা ৫ বছর ধরে জটিল অসুস্থতায় ভোগার পরে গত বছরের ১৮ অক্টোবর সফল হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় লাল্টুর। অন্যের হৃদপিন্ড বসানো হয় লাল্টুর শরীরে। তার আগে এমন সময়ও গিয়েছে, যখন ডাক্তাররা প্রায় জবাব দিয়েই দিয়েছিলেন। তাই পম্পা মনে করেছেন, ওই ১৮ অক্টোবর, হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের দিনই কার্যত পুনর্জন্ম হয়েছে লাল্টুর। সেই দিনটিরই প্রথম বর্ষপূর্তিতে কাল, রবিবার এমন বিশাল আয়োজন।

বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটির রাধামাধবপুর গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকেন লাল্টু ও পম্পা। কাল, রবিবার সন্ধেয় সেখানেই হবে অনুষ্ঠান, খাওয়াদাওয়া। লাল্টু পেশায় মাছ ব্যবসায়ী, পম্পা বড়জোড়া-২ পঞ্চায়েত সমিতির শিশু ও নারীকল্যাণ দপ্তরের কর্মাধ্যক্ষ। সুখের সংসারে দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনাতে শুরু করে ২০১৮ সালে। বার বার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন লাল্টু। একটু হাঁটাচলা করলেই প্রবল শ্বাসকষ্ট হতো, মূত্রথলিতে প্রস্রাব জমে পেট ঢাকের মত ফুলে যেত। শুরু হয় মরণ-বাঁচন লড়াই।

পম্পার দাবি, দুর্গাপুর, কলকাতা, ত্রিপুরা — এমনকী ভেলোরে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও স্বামীকে সুস্থ করতে পারেননি তিনি। শেষে ২০২৩-এর মার্চে পম্পা স্বামীকে নিয়ে বেঙ্গালুরুর দেবী শেঠির হাসপাতালে যান। ততদিনে লাল্টুর সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। সেখানেই প্রচুর টেস্টের পরে জানা যায়, লাল্টুর হৃদযন্ত্র অকেজো হয়ে গিয়েছে। সেটি দ্রুত পাল্টানো দরকার। কোথায় মিলবে হৃদযন্ত্র? পেলেও তার সফল প্রতিস্থাপন হবে তো?

একরাশ চিন্তা আর একবুক আশা নিয়ে গ্রামের মেয়ে পম্পার মাসের পর মাস কাটতে থাকে বেঙ্গালুরুতে। লাল্টুর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে যান তিনি। ডাক্তাররাও আশা দেখতে পাচ্ছিলেন না। পাঁচ মাস পরে হঠাৎ আসে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের সুযোগ। বেঙ্গালুরুতে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান ২১ বছরের এক তরুণ। তাঁর পরিবার কিডনি, লিভার, হার্ট — সবকিছুই দান করে দেন। সেই তরুণেরই হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয় লাল্টুর শরীরে। ২০২৩-এর ১৭ অক্টোবর রাত ১১টায় শুরু করে ১২ ঘণ্টা ধরে চলে অস্ত্রোপচার। তার পরে টানা ২৪ দিন কোনও রকম স্টিচ ছাড়াই লাল্টুর হার্ট ওপেন রাখা হয়।

প্রবীণ হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সার্জেন তাপস রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, নিশ্চয়ই ওই রোগীর সেন্ট্রাল একমো (এক্সট্রা কর্পোরিয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন) সাপোর্ট দরকার পড়েছিল, যা একযোগে হার্ট ও লাঙের কাজ করে কৃত্রিম জীবনদায়ী ব্যবস্থায়। প্রতিস্থাপনের পরে হার্ট নিজে নিজে স্পন্দিত না হলে এ রকম কারও কারও সাপোর্ট লাগে। সে জন্যই নিশ্চয়ই ২৪ দিন বুকের স্টারনাম, পাঁজর ও চামড়া জোড়া লাগানো হয়নি।

চিকিৎসার জন্য বেঙ্গালুরুর ওই হাসপাতালে টানা ৯৬ দিন ভর্তি ছিলেন লাল্টু। দিতে হয়েছিল ৪৭ বোতল রক্ত। পম্পা, তাঁর বোন ঝুমা, ঝুমার স্বামী তাপস মিলে মাত্র ৫ বোতল রক্ত দিতে পেরেছিলেন। বাকি রক্ত দিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর অটোচালকেরা। পম্পা কিছুই ভোলেননি। মা অনিতার পাশে থাকা, বোনঝির একাই মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নেওয়া, কিছু স্বজনের হঠাৎ দূরে চলে যাওয়া। কান্নাভেজা গলায় শুক্রবার বলছিলেন, ‘কয়েকটা দিন যমে মানুষে টানাটানি চলেছে। স্বামীকে ফিরে পাব, সে আশার থেকে আশঙ্কাই ছিল বেশি। ওঁর আসল জন্মদিন ১০ অক্টোবর হলেও গত বছর ১৮ অক্টোবর ঈশ্বর ওঁকে পুনর্জন্ম দেন। সেটারই বর্ষপূর্তি পালন করা হচ্ছে ধুমধাম করে।’

স্ত্রীর এই আয়োজনে আপ্লুত লাল্টু। বলছেন, ‘যে মেয়ে কোনওদিন একা কলকাতা তো দূর, দুর্গাপুরেই যায়নি, সেই মেয়েটাই ভিন্ রাজ্যে গিয়ে সংগ্রাম করে আমাকে বাঁচিয়েছে। এমন স্ত্রী সবার ভাগ্যে জোটে না!’ জম্পেশ মেনুও সাজিয়েছেন পম্পা। রুই, কাতলা, ভেটকি, বাগদার পাশাপাশি চিকেন, মটন, পনির, পোলাও, বিরিয়ানি, ডিম, মিষ্টিও থাকছে পাতে। অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত থাকছেন বড়জোড়ার বিডিও কার্তিকচন্দ্র রায়। তাঁর কথায়, ‘বেহুলা যে ভাবে লড়াই করে লখিন্দরকে বাঁচিয়েছিলেন, পম্পাও তেমনটা করেছেন লাল্টুর জন্য। এই গল্প অনুপ্রাণিত করবে মহিলাদের।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *