অরূপ লাহা: রথ এলেই মনে পড়ে না-পারার এক বেদনার ছবি। তবুও থেমে থাকে না জগন্নাথ (Jagannath)। দু’হাতে নেই স্পর্শ করার সাধ্য, তবুও জগৎকে টেনে নেন নিজের ইচ্ছার রথে। তিনি নিজেই দৃষ্টান্ত — শারীরিক সীমাবদ্ধতা কোনও বাধা নয়, যদি লক্ষ্য থাকে স্থির। আজ সেই জগন্নাথই হয়ে উঠেছেন মানুষ তৈরির কারিগর। নিজের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুপ্রেরণা জোগান অসংখ্য হৃদয়ে। জগন্নাথ মানেই বিশ্বাস। জগন্নাথ মানেই লড়াই করে এগিয়ে চলা।
আর রথযাত্রা? সেটা শুধু এক ধর্মীয় উৎসব নয় — এক অধ্যবসায়, অটুট মনোবল আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। এই গল্পের নায়ক, পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের বেলোটি গ্রামের জগন্নাথ বাউরি। জন্ম থেকেই তার দু’টি হাত নেই, কিন্তু সেই অক্ষমতা তাঁকে আটকাতে পারেনি। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হন। আজ তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক, যার শিক্ষাদানের নেশা অন্যদের চেয়ে কম কিছু নয়।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জগন্নাথ বাবু বলেন, “জন্ম থেকেই আমার দুটো হাত নেই। কিন্তু আমি অসুবিধা বলতে কিছু বুঝি না। মনোবলই আমার ঈশ্বর”। বর্তমানে জগন্নাথ তার বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার স্কুলের পড়ুয়ার সংখ্যা ১৬৯ আর শিক্ষক শিক্ষিকা মিলিয়ে মোট ৬ জন।
তিনি আরও জানান, তাঁর জীবন বদলে দেওয়া মানুষ ছিলেন শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় ভূতনাথ পাল। “উনি আমার বাড়ি গিয়ে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। পায়ের আঙুলের মাঝে পেন্সিল গুঁজে স্লেটে লেখা শিখিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু আমার পথচলা।” প্রথমে মা-ও ছিলেন সংশয়ে। কিন্তু ভূতনাথ পালের দৃঢ় উচ্চারণ ছিল -“এটা আমার চ্যালেঞ্জ। আমি লেখাপড়া শেখাবোই”। সেই চ্যালেঞ্জ আজ বাস্তব।
আজকের দিনে তিনি নিজেই অনেকের অনুপ্রেরণা — জগন্নাথ বাউরি, একজন গর্বিত শিক্ষক। রথযাত্রা উপলক্ষে আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বলেন, “বাবা জগন্নাথেরও তো দুটো হাত নেই, আমারও নেই। রথ টানতে বড় ইচ্ছে করে, কিন্তু ভগবান আমায় হাত দেননি, রথ আমি টানবো কিভাবে”! জগন্নাথের এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এখন ভরা সংসার। তার স্ত্রী লক্ষ্মী বাউরি তাকে সব সময়ে প্রেরণা জোগান।
এক সময়ে এলাকার বাসিন্দারা জগন্নাথকে নিয়ে খুব সংশয়ে ছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা তরুণা মাজি বলেন, প্রথমে যখন তিনি স্কুলে আসতেন তখন আমরা অনেকেই স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতাম। ঠিক মত পড়াতে পারছেন কি না। তবে সেই ভুল বা ভ্রান্তি কেটে যায় তার ক্লাস নেওয়া দেখে। মনিকা মাজি বলেন, জগন্নাথ স্যার ভগবান। জগন্নাথ বাউরির আচার-আচরণে ও কাজে মুগ্ধ তার সহকর্মীরাও।
স্কুলের শিক্ষক চন্দন মণ্ডল বলেন, সব সময়ে তিনি তাদের আগলে রাখেন। তিনি শুধু স্কুলের প্রধান শিক্ষক নন। সবার অবিভাবক। একই কথা বলেন, স্কুলের আর এক শিক্ষিকা রোমানা মণ্ডল।তিনি বলেন,জগন্নাথদা সব সময়ে হাসিখুশি থাকেন। শুধু স্কুলে নয়,তিনি বোর্ডের সব কাজ করেন আর পাঁচ জনের মতই। জগন্নাথের কথা, তার জীবন যেন রথের মতোই — চাকা ঘুরে চলে সীমাহীন পথে, হাত না থাকলেও মন দিয়ে টেনে নিয়ে চলে অগণিত বিশ্বাসকে।
আরও পড়ুন, Kalna News: কালনায় দুই সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের জন্য পৃথক রান্নার ব্যবস্থা, মিড ডে মিলেও আমরা-ওরা
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)