মহাসপ্তমীর কলাবউ-ই আসল ‘দুর্গা’! কৃষিসভ্যতার উদযাপনেই লুকিয়ে দুর্গারহস্য! পড়ুন উদ্ভিদপুজোর প্রকৃত মাহাত্ম্য…। Durga Puja 2025 Nabapatrika a bundle of nine different auspicious plants worshipped as divine manifestation of Goddess Durga


সৌমিত্র সেন: এসে গেল পুজো (Durga Puja 2025)। আর ক’দিন পরেই ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী– চারদিনের আনন্দ উদযাপন। তারপর দশমীর বিষাদ। পুজোর প্রতিটি দিনেই থাকে কিছু বিশেষ উদযাপন। যেমন, ষষ্ঠীতে বোধন, সপ্তমী (Durga Saptami) মানেই নবপত্রিকা (Nabapatrika) স্নান। অষ্টমীতে সন্ধিপুজো। এর মধ্যে নবপত্রিকা খুবই স্পেশাল। একটু ভেবে দেখলেই দুর্গাপুজোর এই একটি বিষয়ই পুজোর আচারে সম্ভবত সবচেয়ে খাপছাড়া দেখায়। দুর্গা স্বয়ং এক দেবীর আরাধনা, সেখানে আর এক দেবীর পুজো– নবপত্রিকাকে দেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়। শুধু তাই নয়, নবপত্রিকাকে চলতিতে বলা হয় ‘কলাবউ'[ (kalabou)। তাঁকে গণেশের (Lord Ganesha) বউ মনে করা হয়। গণেশমূর্তির পাশেই রাখা হয় তাঁকে।

Add Zee News as a Preferred Source

দুর্গাসপ্তমীর ভোর এবং কলাবউ

দুর্গাসপ্তমীর ভোরে গঙ্গাতীরে বা অন্য কোনও নদীঘাটে বা জলাশয়ে নবপত্রিকা স্নান বা কলাবউ স্নান করানো হয়। এটি দুর্গাপুজোর অপরিহার্য অঙ্গ। আপাতদৃষ্টিতে যেন একটি কলাগাছ কাঁধে করে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়।
কলাবউকে সাধারণত গণেশের বউ বলা হয়। তা নয়। কলাবউ দুর্গারই এক রূপ, সেই হিসেবে কলাবউ গণেশের মাতৃস্থানীয়া। 

ন’টি উদ্ভিদের গুচ্ছ

কলাবউ আসলে ন’টি উদ্ভিদের এক গুচ্ছ। এতে থাকে– কলাগাছ, কচু বা কালকচু গাছ, হলুদ গাছ, জয়ন্তী গাছ, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচুগাছ, ধানগাছ। এই ন’টি উদ্ভিদ শ্বেত অপরাজিতা লতা ও লাল সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে।

নয় দেবী

প্রতিটি উদ্ভিদই বিভিন্ন দেবীর প্রতীক:

কলা গাছ: কদলী বা রম্ভার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রহ্মাণী
কচু গাছ: কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালিকা।
হলুদ গাছ: হরিদ্রা বা হলুদ গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন উমা
জয়ন্তী গাছ: জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কার্তিকী
বেল গাছ: বিল্ব বা বেল গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন শিবা
ডালিম গাছ: দাড়িম্ব বা ডালিম গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন রক্তদন্তিকা
অশোক গাছ: অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন শোকরহিতা
মান গাছ: মান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন চামুণ্ডা
ধান গাছ: ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী

কৃষিসভ্যতার উদযাপন

বলা হয়, দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই আচারে আসলে বাংলার কৃষিসভ্যতার নীরব উদযাপন। এই সময়ে যে নতুন ফসল ওঠে, সেই ফসলেই সারা বছর ধরে সাধারণ মানুষ তাদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে। শস্যই সম্পদ। তাই বাংলার সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ উদ্ভিদকেই পুজো করেন।

ভাগবতের দশম স্কন্ধের বিংশ অধ্যায়ের ৪৮ নম্বর শ্লোকে আছে– 

”পুরগ্রামেষ্বাগ্রয়ণৈরৈন্দ্রিয়ৈশ্চ মহোৎসবৈঃ।
বভৌ ভূঃ পক্কশস্যাঢ্যা কলাভ্যাং নিতরাং হরেঃ।।” 

এর অর্থ– শরৎ এলে নগরে গ্রামে উৎসব শুরু হয়ে যায়। দু’রকমের উৎসব– নবান্ন ভোজনের জন্য বৈদিক যাগযজ্ঞ এবং সঙ্গে কিছু লৌকিক উৎসব। এই শ্লোকের উল্লেখ এখানে একটাই কারণে। তা হল, ওই ‘পক্কশস্যাঢ্যা ভূঃ’; যেখানে শরতে পক্বশস্যপূর্ণ ধরিত্রীর কথা বলা আছে। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে, শরতে শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার ঐতিহ্য আজকের নয়। আর উদ্ভিদের মাধ্যমে শস্যস্নাত শরৎ ঋতুকে পুজো করার ঐতিহ্যও অতি প্রাচীন। স্বয়ং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নবপত্রিকার ব্যাখ্যায় এই তত্ত্বের উল্লেখ করেছেন।

শ্রী ও লাবণ্য 

ফলত, ঢাক বাজিয়ে নবপত্রিকা বা কলাবউ স্নান কিংবা দুর্গাপুজোর চারদিন ধরে গণেশমূর্তির পাশে তাঁকে রেখে পুজো করার মধ্যে দিয়ে আসলে ধরিত্রীমাতার আদিতম প্রাণের স্ফুরণের প্রতিই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শুধু শ্রদ্ধা নয়, এর মধ্যে প্রার্থনাও থাকে। শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে প্রার্থনা– যেন প্রতি বছরই বিপুল শস্য উৎপাদিত হয়, তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা কমে, সংসারে শ্রী ও লাবণ্য বিরাজ করে। পুরাকালে বসন্তে দুর্গাপুজো হত। সেই বাসন্তী দুর্গার আরাধনার সঙ্গে এই উদ্ভিদপুজোর কোনও যোগ ছিল না। কিন্তু রামচন্দ্রের অকালবোধনে যেদিন থেকে শরতের সময়ে দুর্গাপুজো শুরু হল, তখন থেকেই আবহমান কাল থেকে চলে আসা উদ্ভিদপুজোও এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে জুড়ে গেল। আর দুর্গাসপ্তমীর অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল আজকের ‘কলাবউ’।

পুজো নির্ঘণ্ট, ২০২৫

প্রসঙ্গত, দেখে নিন এবার কবে থেকে পুজো শুরু, কোন তিথি কতক্ষণ থাকছে, কখন অষ্টমীর অঞ্জলি, কখন সন্ধিপুজো ইত্যাদি:

১০ আশ্বিন (১৪৩২ বঙ্গাব্দ) ২৭ সেপ্টেম্বর (২০২৫ সাল) শনিবার পঞ্চমী। সকাল ৮টা ৪৯ পর্যন্ত। সন্ধ্যায় শারদীয়া দুর্গাদেবীর বোধন। ২৮ সেপ্টেম্বর রবিবার ষষ্ঠী। সকাল ১০টা ৪৩ মিনিট পর্যন্ত ষষ্ঠী। ফলে, এরই মধ্যে ষষ্ঠীবিহিত পূজা সমাপন করে ফেলতে হবে। সায়ংকালে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ২৯ সেপ্টেম্বর সোমবার বেলা ১২টা ২৮ পর্যন্ত সপ্তমী। এদিনই দেবীর নবপত্রিকা। ৩০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মহাষ্টমী। এদিনই মহাষ্টমীর ব্রতোপবাস। বেলা ১টা ৪৫ পর্যন্ত অষ্টমী। মহাষ্টমীর দিনই সন্ধিপূজা। বেলা ১টা ২১ গতে সন্ধিপূজা আরম্ভ, ২টো ০৯ মধ্যে সমাপন। ১টা ৪৫ গতে বলিদান। ১ অক্টোবর বুধবার মহানবমী। বেলা ২টো ৩৬ মিনিট পর্যন্ত নবমী। তবে, কালবেলানুরোধে সকাল ৮টা ২৯ মিনিট মধ্যে মহানবমীবিহিত পুজো।  ২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার (যেদিনটি আবার গান্ধীজয়ন্তীও) বিজয়া দশমী। এদিন বেলা ২টো ৫৬ পর্যন্ত দশমী তিথি। দুর্গাদেবীর দশমীবিহিত পুজো সমাপনান্তে বিসর্জন প্রশস্ত। 

দেবীর গজে আগমন। ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। দেবীর দোলায় গমন। ফল– মড়ক।

(Disclaimer: প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, কোনও সুপারিশ করা হচ্ছে না।)

(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)





Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *