সপরিবার দুর্গার মুখোশ এত দিন ছিল পুরুলিয়ার মুখোশ গ্রাম চড়িদার মূল আকর্ষণ। সময়ের সঙ্গে সেটাই হয়ে ওঠে ব্র্যান্ড। রঙে, রাংতায় তৈরি সেই মুখোশের সঙ্গে ছৌ-নাচ সমাদর পেয়েছে বিশ্বের রসিককুলের কাছে। সেই একমুখী সৃষ্টি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন চড়িদার শিল্পীরা। এবার তাঁরা তৈরি করছেন মনীষীদের মুখোশ। তাতে রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ সবাই রয়েছেন। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, এই বদল পছন্দ করছেন পুরুলিয়ায় বেড়াতে আসা পর্যটকরা।
পুরুলিয়ায় পর্যটনে প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে চড়িদা গ্রামের মুখোশ শিল্প। পর্যটকরা পাহাড়, জঙ্গল, জলাধার, ঝরনার সঙ্গে একবার ঘুরে দেখেন চড়িদা গ্রামও। জেলায় পর্যটনের প্রসারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হোটেল, রিসর্টের সংখ্যা। বহু পর্যটক উত্তরবঙ্গের ভিড় এড়িয়ে চলে আসছেন এই রাঢ়ভূমে। ফলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে শুধু দুর্গা, গণেশে নিজেদের আটকে রাখতে চাইছেন না শিল্পীরা। চড়িদায় গেলে এখন মুখোশের দোকানগুলিতে দুর্গা, গণেশ, অসুরের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মুখোশও। কেউ শুধুই সাদা আবার কোনও শিল্পী তাতে রঙের আদলও দিচ্ছেন।
কোভিডের সময় চরম মন্দার মুখে পড়েছিল মুখোশ গ্রাম। সেই মন্দা কাটিয়ে গত দু’বছরে ধীরে ধীরে ফের ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে চড়িদা। এই সময়েই চিরাচরিত ছৌ মুখোশে ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে আনার কথা ভাবতে শুরু করেন শিল্পীরা। শুরু হয় দেশের মনীষীদের আদলে মুখোশ নির্মাণ। চড়িদার ছৌ শিল্পী মিন্টু সূত্রধরের কথায়, ‘মানুষ নতুন কিছু চাইছিলেন। সেটাই করার চেষ্টা করেছি আমরা।’
কাগজ, কাপড় এবং কাবিস (তরল মাটি) দিয়ে প্রস্তুত মহাপুরুষদের মুখোশ চিরন্তন ছৌ মুখোশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে এখন। মিন্টু বলেন, ‘দু’টি বিষয়ের কথা মাথায় রেখে গড়া হচ্ছে মহাপুরুষদের মুখোশ। দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার জন্য। আর কিছু মুখোশ রাখা যাবে টেবিলে।’ চড়িদায় মুখোশের দোকান রয়েছে দীপেশ সূত্রধরের। গত শীতে নতুন আঙ্গিকের এই মুখোশের বিক্রি তাঁদের যথেষ্ট ভালো হয়েছিল বলে জানান তিনি। আড়াইশো থেকে হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি।
টেবিলে রাখার জন্য তাঁর মূর্তির চাহিদা বেশি বলে জানান তিনি। পঞ্চায়েত নির্বাচন মিটলেই চড়িদার শিল্পীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে পৌঁছবে। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, নতুন কাজে হাত দিলেও আরও নিখুঁত করার সুযোগ রয়েছে। সেই পরীক্ষা নিরীক্ষাতেই এখন ব্যস্ত চড়িদার শিল্পীরা। কলকাতা লাগোয়া নিউ টাউনের বাসিন্দা পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী শিউলি মুখোপাধ্যায় পুরুলিয়া এলেই বন্ধু, পরিজনের জন্য ছৌ মুখোশ কিনে নিয়ে যান। এবার রবীন্দ্রনাথ ও স্বামীজির মুখোশ কিনেছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমার প্রিয় মুখোশ কিন্তু দেবী দুর্গার। তার কোনও তুলনা হয় না। গণেশের মুখোশও খুব প্রিয়। তবে রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের মূর্তিতে নতুনত্ব পেলাম। এই মুখোশগুলি আর একটু নান্দনিক করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছে।’
পুরুলিয়ার লোক-গবেষকদের মতে মূলত অর্থনৈতিক কারণে এই বিবর্তন ঘটছে। বিশিষ্ট লোক-গবেষক নিমাইকৃষ্ণ মাহাতোর মতে, ‘নাচের জন্য যে ছৌ মুখোশ তার চাহিদা সীমিত। মূলত ছৌ নৃত্যশিল্পীরা এই মুখোশ কেনেন। এর খরচ অনেক বেশি। এই মুখোশগুলিকে রীতিমতো সাজাতে হয়, প্রচুর পরিশ্রমও হয় শিল্পীদের। তাতেই দাম অনেক বেড়ে যায়।’ তাঁর কথায়, মনীষীদের মুখোশ সাজানোর প্রয়োজন পড়ে না। ছাঁচে ফেলে একটু রং করে দিলেই হলো। অথচ পর্যটকরা মনীষীদের মূর্তি বাড়িতে রাখতে পছন্দ করছেন। বলেন, ‘চড়িদার শিল্পীরা অর্থনৈতিক দিকটির কথা ভেবে এই ধরনের মুখোশ তৈরির পথ বেছে নিচ্ছেন। তবে লোক-সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমার মনে হয় এটা সাংস্কৃতিক ক্ষতি।’