তৃণমূলেরও অনেক জয়ী প্রার্থীকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে অবশ্য টাকার টোপ বা হুমকি নয়, দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই প্রধান কারণ বলে অভিযোগ। প্রশ্ন উঠেছে, ভোটে জেতার পরেও কেন এমন অবস্থা? অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো, ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েত। মালদা জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৪৬টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৫৯টি, বিজেপি ১৬টি ও কংগ্রেস ৭টি দখল করলেও ৬৪টি পঞ্চায়েতে কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ১৫টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যেও ৪টি ত্রিশঙ্কু হয়ে রয়েছে।
তাই দল ভাঙানোর খেলা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ। ওই জেলায় বিজেপি কার্যালয় শ্যামাপ্রসাদ ভবনের দোতলা বিশাল বাড়িটা যেন শরণার্থী শিবির। প্রতিটি ঘরে গাদাগাদি করে নিজেদের পরিবার নিয়ে রয়েছেন বিজয়ী প্রার্থীরা। আর শুধু মালদা নয়, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বিজেপির জয়ী সদস্যরাও ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে এখানেই আশ্রয় পেয়েছেন।
জেলা বিজেপির মুখপাত্র অজয় গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘কোথাও পুলিশি হয়রানি, কোথাও তৃণমূলের তরফে টাকার টোপ বা অপহরণের হুমকি চলছেই। এখন তো আর পার্টি অফিসেও রাখবার ভরসা পাচ্ছি না। আজ থেকেই এদের অন্যত্র পাঠানো শুরু হয়ে গিয়েছে।’ জেলার সিপিএম জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র বলেন, ‘বিজেপির মতো আমাদের টাকা নেই। তাই বিজেপির মতো সাংগঠনিক ভাবে আশ্রয় শিবির করতে পারিনি। তবে প্রার্থীরা নিজেদের ব্যবস্থাতেই বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।’
জেলা কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি কলিসাধন রায়ের কথায়, ‘আমাদের জয়ী প্রার্থীদের জেলাতেই রাখছি না। ঝাড়খণ্ড-সহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ শুধু বিরোধী নয়, শাসক তৃণমূলের ঘরেও একই চিত্র। মালদা শহরের কোনও হোটেলের ঘর খালি নেই। তৃণমূলের জয়ী প্রার্থীদের বেশিরভাগই সেখানে রয়েছেন। একই অবস্থা বীরভূমে। এই জেলায় পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি ধরলে সব মিলিয়ে জেলায় ৩৫০-এরও বেশি জয়ী বিজেপি প্রার্থীদের সিংহভাগ এখন ঘরছাড়া। জেলা বিজেপির সভাপতি ধ্রুব সাহা বলেন,’ অপহরণের আশঙ্কায় আমাদের বহু জয়ী প্রার্থীকে অন্য রাজ্যে পাঠাতে বাধ্য হয়েছি।’
মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা-২ ব্লকের বান্দিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৫টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৭টি, বিজেপি ৭টি এবং সিপিএম জিতেছে একটি আসনে। পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনে আশাবাদী তৃণমূল ও বিজেপি দুই শিবিরই। পঞ্চায়েত নিজেদের দখলে রাখতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে দুই পক্ষই। সিপিএম-এর জয়ী প্রার্থীকে দলে টানতে ময়দানে নেমে পড়েছে দুই দল।
এই দড়ি টানাটানির মধ্যে তৃণমূল ও বিজেপির থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে তাঁদের একমাত্র জয়ী প্রার্থীকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছে সিপিএম। দলের নেতা গুরুপদ দত্ত বলেন, ‘আমাদের জয়ী প্রার্থীকে নানা ভাবে প্রলোভন, ভয় দেখানো হচ্ছে।’ চন্দ্রকোনার বিধায়ক অরূপ ধাড়া বলেন, ‘গোটা রাজ্যে সবুজ ঝড় বইছে। দেখুন বোর্ড গঠন কে করে! সময় হলে সবই বুঝতে পারবেন।’
তৃণমূল যাতে বিজেপির জয়ী প্রার্থীদের হাইজ্যাক করে না নেয়, সে জন্য বিজেপির নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলাতেই দলের ৬৫ জন জয়ী প্রার্থীকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। দক্ষিণ জেলার সভাপতি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাইজ্যাক করে নিতে চোখ রাঙানো, ভয় দেখানো, আর্থিক প্রলোভন দেখানো ইত্যাদি নানা কৌশল করছে তৃণমূল।
কোথাও এ কাজে সঙ্গে পুলিশকেও নিচ্ছে। শুধু রানাঘাট দক্ষিণ জেলাতেই আমরা আমাদের ৬৫ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে গোপন ডেরায় রাখতে বাধ্য হয়েছি। শান্তিপুর পঞ্চায়েত সমিতি আমাদের দিকে এসেছে বলে এই ব্লকে তৃণমূলের এরকম সন্ত্রাস ও কৌশল ইত্যাদির ঘটনা বেশি। এ দিকে, শান্তিপুর ব্লকের বাবলা গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রধান পদের (সংরক্ষিত পদ) দাবিদার বিজেপির তফশিলি উপজাতির দুই জয়ী প্রার্থীর মধ্যে একজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁর বাড়ির লোকজন।
এই পঞ্চায়েতে তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রধান পদটি তফশিলি উপজাতি সংরক্ষিত হওয়ায় সমস্যায় পড়েছে তৃণমূল। ২৬ আসনের মধ্যে তৃণমূল ১৫টিতে জিতলেও তাদের দলের তফশিলি উপজাতির কেউ জেতেননি। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির টিকিটে জেতা সংরক্ষিত আসনের এক মহিলা প্রার্থী তারা বাবুরায়কে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তাঁর পরিবারের লোকজন।