মধুবন্তী বাগচী
২০২০ সালে লকডাউনের ঠিক পরপর…
আমার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও ‘গডফাদার’ নেই। এমন কেউ ছিল না, যিনি আমায় কোনও না কোনও ভাবে পাশে দাঁড়াত। গান শুনে আরও পাঁচজনকে বলত, আমার কথা, আমার গানের কথা। নিজের উপর বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই ছিল না আমার। এভাবে পাঁচ-পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলাম, মুম্বইতে। ২০২০ সালে লকডাউনের ঠিক পরপর কাজের সূত্রে স্যরের সান্নিধ্যে আসা। স্যর মানে, সঞ্জয় লীলা বনসালী। বলিউড মিউজিকের স্তম্ভ। বলিউড কেন বলছি, ভারতীয় মিউজিকে তাঁর স্বকীয়তা রয়েছে। সবার মাঝে থেকেও তিনি কোথাও আলাদা। সঞ্জয় স্যরের একটা আলাদা পছন্দ আছে। ক্ল্যাসিকাল মিউজিক। তবে তা হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিকাল নয়। এবং এই ক্ল্যাসিকাল মিউজিকই আমায় পরিচিতি দিয়েছে। আমার ধারণা ছিল, যে কখনও হয়তো স্যরের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসবে। তবে, সময় যে এত সহজভাবে আমাকে তাঁর কাছে ঠেলে দেবে, তা অপ্রত্যাশিত ছিল। সঞ্জয় স্যারের অন্যতম মিউজিক অ্যসিস্টেন্ট, শ্রেয়াস পুরানিকের সঙ্গে একটা সিঙ্গলসে কাজ করি। তখনও আমি জানতাম না শ্রেয়াস, সঞ্জয় স্যারের অ্যসিস্টেন্ট। ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল কাজের পরেও। প্রায় এক বছর পর হঠাত্ করে একদিন ফোন করে শ্রেয়াস বলে, ‘‘স্যার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’’
গলা কাঁপছে তবু ‘নদিয়া বইরি ভায়ি’…
এক সন্ধেতে স্যরের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মনের মধ্যে একটা ভয়ভয় ছিল। কারণ সঞ্জয় স্যরকে দেখতে খুব রাগী-রাগী মনে হয়। ওঁর পার্সোনালিটি একটু বেশিই সিরিয়াস টাইপের। বলিউডের অনেকের গুণী মানুষের সঙ্গে দেখাটেখা করেছি, কিন্তু এমন বড় মাপের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত্ এই প্রথমবার। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। তিনি এলেন। বললেন বসতে। তারপর একে একে প্রশ্ন ছুঁড়লেন। ‘‘কোত্থেকে এসেছো?’’, ‘‘কোথায় থাকো?’’, ‘‘বাড়িতে কে কে থাকেন?’’, ‘‘কী কী গান জানি?’’, ‘‘কোন ধরণের গান ভালবাসো?’’ এবং শেষমেশ, ‘‘একটা গান শোনাও’’।
এবার আমার ভয় আরও চড়া হল। কাঁপা কাঁপা গলায় ধরলাম গান। ঠুমরি। ‘নদিয়া বইরি ভায়ি’। দু-তিন লাইন। শেষ করে আমি স্যরের মুখের দিকে চেয়েছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওঁর অভিব্যক্তি। যা বুঝলাম তা হল, স্যর যা খুঁজছিলেন তাঁর গানের জন্য, তা উনি পেয়েছেন। আরও নিশ্চিত হলাম, যখন স্যর শ্রেয়াসকে বলেন, ‘‘তুমি জানতে না এমন গলা আমি খুঁজছি, ওঁর সঙ্গে তুমি কাজ করেছো, আমাকে আগে বলোনি তো?’’
তারপর উনি তাঁর অ্যালবাম, ‘সুকুন’-এর (sukoon) বিষয়ে বলেন এবং ‘সিভা তেরে’ (siva tere) গানটির দু’কলি নিজে গেয়ে শোনান, এবং বলেন আমাকেও ধরতে। আমি গানটি শুনে তুলে ফেলি। গেয়ে শোনাই। তারপর উনি গানটির স্ক্র্যাচ রেকর্ড করতে বলেন। ঠিক তারপর দিন ছিল রেকর্ডিং।
যা ইচ্ছে গাও..কিচ্ছু বলব না
স্ক্র্যাচ রেকর্ডিংয়ের পর এল ফাইনাল রেকর্ডিংয়ের ডাক। সঞ্জয় স্যর ছিলেন স্টুডিয়োতে। সেদিন বুক দুরদুর করছিল খুব। কোনওদিন এমনটা হয়নি। কী হতে পারে আর কী হতে পারে না, এসব মাথায় চলছিল। যা দেখলাম এবং বুঝলাম তা হল, সঞ্জয় লীলা বনসালী ভীষণ স্পেসিফিক একজন সুরকার। ওঁর মাথায় যা চলে তা খুব স্পষ্ট। উনি জানেন কী চাইছেন, কী চাইছেন না। মানে কোনও হরকত বা মুড়কি, গানের কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় তাঁর দরকার মানে ওটা তাঁর লাগবেই। একটু ভয়েই ছিলাম। তবে গান গাওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘‘তোমার যা মনে হয় তুমি করবে, আমি তোমায় আলাদা কিছু বলব না,’’ গানের শেষে তিনি আর কিছুই বলেনি। ভাল হয়েছিল বলে বোধ হট আর কিচ্ছু বলেননি। ঠিক এভাবেই শুরু হল দুই মানুষের এক সুরেলা সম্পর্ক। তারপর থেকে আমি সঞ্জয় স্যরের সুরে একাধিক গান গেয়েছি। সেই সুরেলা সম্পর্ক ভীষণ ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছে।

‘লতাদিদি’ ঈশ্বর…
সময় বয়ে গিয়েছে। এমনও দিন গিয়েছে, আমি আর স্যর টানা পাঁচ-ছয় ঘন্টা আড্ডা দিয়েছি। সঞ্জয় স্যরের কাছে ওঁর দেখা আরডি বর্মন, আশা তাই, বিরজু মহারাজের গল্প শুনেছি। স্যরের কাছে লতাদিদি ঈশ্বর! তাঁর গাওয়া সমস্ত বিরল রেকর্ডিং ওঁর সংগ্রহে রয়েছে। এই সব গুণী মানুষের সঙ্গে ওঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার শোনা। গল্পগুলো আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। তবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গল্প আমরা কখনও করিনি। আমার মনে হয়েছে উনি মিউজিকের মানুষ। ওঁর জন্ম গুজরাটে হলেও মারাঠি মিউজিকের প্রতি ওঁর এক অসম্ভব টান আছে। কত ধরণের গান যে আমাকে শুনতে বলেছেন…শুনছিও।
হঠাত্ রাতে স্যরের ফোন…
সঞ্জয় স্যর নেটফ্লিক্সের একটি কাজ করছেন। ‘হীরা মাণ্ডি’। তাতে আমি গান গেয়েছি। কিছুদিন আগে একদিন হঠাত্ করে ফোন করেন। ঠিক কী কারণে কল করেছিলেন, এখনও জানি না (হাসি)। মনে হল তো কনগ্র্যাচুলেট করার জন্যই ফোনটি এসেছিল। এত ভাল-ভাল কথা এক টানা বলে চললেন…ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। কারও গান শুনে, তিনি এমন করেছেন বলে আমি কক্ষণও শুনিনি। সঞ্জয় লীলা বনসালী, রাতবিরেতে ফোন করে প্রশংসা করছেন! করেই চলেছেন আর থামছেন না! ভাবতে পারছেন? আমি তো এখনও ভাবতে পারছি না। তিন মিনিটের ডিউরেশন ছিল সেই ফোনকলের। আমি কোনও কথাই বলতে পারিনি। শুধু চোখ থেকে জল গড়িয়েছে। শেষে যা বললেন এখনও কানে বাজে, ‘‘অনেক বড় হও, মধুবন্তী। আমি তোমার সঙ্গে কাজ করে সম্মানিত বোধ করছি…’’।
অনুলিখন- শুভঙ্কর চক্রবর্তী
