School In West Bengal : খালি পেটে স্কুলে! খুদেদের ব্রেকফাস্ট দিচ্ছেন টিচাররাই – bardhaman kalna school teachers give breakfast to children


সূর্যকান্ত কুমার, কালনা
‘সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খুব খিদে পেত। কিন্তু বাড়িতে খাবার কিছু থাকত না…’ দিনের পর দিন এমন খালি পেটেই সাতটার মধ্যে স্কুলে হাজির হতো ক্লাস এইটের সায়ন প্রামাণিক, ফাইভের হাসিব মল্লিক, শৌভিক হালদাররা। স্যর জিজ্ঞাসা করতেন, এত শুকনো মুখে বসে আছিস কেন? প্রথমে কোনও জবাব আসে না।কথা কিছুটা এগোতেই শিক্ষক জানতে পারেন, পেটে গনগনে খিদে নিয়ে স্কুলে আসে ছেলেমেয়েরা। খোঁজ নিয়ে জানেন, দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করা ওই ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মা ভোর থাকতেই বেরিয়ে পড়েন কাজে। উনুনে আঁচও পড়ে না। এ দিকে তীব্র গরমে ডে স্কুল শুরু হচ্ছে মর্নিংয়ে। ফলে খালি পেটেই স্কুলে আসছে বহু পড়ুয়া।

স্কুলে মিড-ডে মিল চালু থাকলেও তা শুরু হতে সকাল ১০টা ৪০ মিনিট। অতক্ষণ কি তা হলে পেটে খিল এঁটে বসে থাকবে থাকবে ছেলেমেয়েরা? একরাশ খিদে নিয়ে কি পড়াশোনা চলে? অবস্থা বদলের কথা ভাবতে শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ঠিক করেন, তাঁরাই চাঁদা তুলে পড়ুয়াদের ব্রেকফাস্টের বন্দোবস্ত করবেন।

পেট ভরবে, পু্ষ্টিগুণও থাকবে, এমন খাবারের কথাই ভাবা হয়। সেই ভাবনা কার্যকর হয়েছে। এখন স্কুলে আসার পরে প্রথমেই ছাত্রছাত্রীদের হাতে দেওয়া হচ্ছে ছোলাসিদ্ধ। আগে খাওয়া, পরে পড়া। এই নিয়মই চালু হয়েছে নাদনঘাটের রামপুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, মর্নিং স্কুল যতদিন চলবে, ছাত্রছাত্রীদের ভেজানো ছোলা খাওয়ানো হবে।

এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু শনিবার বলেন, ‘আমি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। পাশাপাশি বাচ্চারা যাতে ঠিকমতো মিড ডে মিল পায়, তা-ও যেন তাঁরা দেখেন।’

প্রাথমিকের পড়াশোনা ও পড়ুয়াদের নিয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত, প্রতীচী ট্রাস্টের প্রাক্তন কর্তা কুমার রাণার পর্যবেক্ষণ, ‘এটা অবশ্যই একটা বড় সমস্যা। সরকার যদি সকালে বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা করে, তা হলে খুব ভালো হয়। তামিলনাড়ুতে এমন বন্দোবস্ত চালু রয়েছে। সেখানে সকালবেলা নানা রকমের ছাতু ও গুড় দিয়ে বেশ সুস্বাদু একটা মণ্ড দেওয়া হয় পড়ুয়াদের।’ এমন কোনও ভাবনা কি সরকারের আছে? ব্রাত্য বলেন, ‘এটা কথা বলে দেখতে হবে।’

রামপুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ছোট স্কুল নয়। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১,১০০। আশপাশের ৩২টি গ্রাম থেকে পড়ুয়ারা আসে স্কুলে। তবে আপাতত পঞ্চম থেকে অষ্টমের ছাত্রছাত্রীদেরই দেওয়া হচ্ছে খাবার। এই ৪টি ক্লাসে পড়ুয়ার সংখ্যা ৫৭৮। এদের জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন ১০ কেজিরও বেশি ছোলা। ছোলার দাম ৯০ টাকা কেজি।

ফলে দৈনিক খরচ প্রায় ৯০০ টাকা। মাসে ২০ দিনও যদি ছোলা দেওয়া হয়, তা হলে মোট খরচ ১৮ হাজার টাকা। চাঁদা তুলেই এই টাকা জোগাড় করবেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।

সরকারি স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমশ কমছে। গ্রামাঞ্চল আদৌ ব্যতিক্রম নয়। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের বিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে উদ্যোগী শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এবং তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পাচ্ছে পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য। শিক্ষকদের বক্তব্য, স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে তবেই পড়ায় মন বসবে।

এমন ভাবনা থেকেই নদিয়ার রানাঘাট ১ ব্লকের দোহারপাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের জন্য এসি রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি ক্লাসরুমে লাগানো হয়েছে ২ টনের এসি, যা কেনা থেকে বিদ্যুৎ বিলের মাসিক খরচ বহন করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাই। তেমনই উদ্যোগ নাদনঘাটের রামপুরিয়া স্কুলের টিচারদের।

স্কুলের শিক্ষক অরূপ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকই মাঠে কাজ করেন। গরমে তাঁরাও খুব সকালে কাজে বেরিয়ে যান। এখন মর্নিং স্কুল হওয়ায় ছেলেমেয়েদের খাবার জুটছে না। খালিপেটেই স্কুলে আসছে তারা। ঘটনাটি আমাদের নজর এড়ায়নি। শুকনো মুখ দেখে কারণ জানতে চাইলে ওরা জানায়, পেটে খিদে। তখনই আমরা স্কুলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই।’

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপনকুমার দাসের কথায়, ‘ছোলা কেনার খরচ শিক্ষক-শিক্ষিকারাই চাঁদা তুলে দিচ্ছি। সরকারি নির্দেশিকায় ৩০ জুন পর্যন্ত মর্নিং স্কুলের কথা বলা হয়েছে। যত দিন মর্নিং স্কুল চলবে, ছোলা দেওয়া হবে।’ জেলা স্কুল পরিদর্শক শ্রীধর প্রামাণিক বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষকদের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।’ নাদনঘাট পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কামালউদ্দিন শেখ জানিয়েছেন, স্কুল থেকে বিষয়টি জানানো হলে, তাঁরা পাশে থাকার কথা ভাববেন।

স্কুলে এসেই খাবার পেয়ে খুশি পড়ুয়ারা। সেই সূত্রেই সায়ন, হাসিব, শৌভিকরা বলে, ‘সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খুব খিদে পেত। কিন্তু বাড়িতে খাবার কিছু থাকত না। স্কুলে এসে আগে ছোলা খাই, পেটটা তখন ঠান্ডা হয়।’ কালনা মহকুমা হাসপাতালের সুপার-চিকিৎসক চন্দ্রশেখর মাইতি বলেন, ‘ছোলা হলো ডাল জাতীয় খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। পুষ্টিগুণ খুব ভালো।’

ডায়েটিশিয়ান রঞ্জিনী দত্তও বলেন, ‘এটা অত্যন্ত ভালো প্রয়াস। ছোলা থেকে প্রোটিন পাবে বাচ্চারা। এর সঙ্গে যদি মুড়ি দেওয়া যায় তা হলে কার্বোহাইড্রেটও পাবে। ডালের থেকেও বেশি উপকারী ছোলা।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *