অর্ণবাংশু নিয়োগী: চিৎপুরে ১০ বছর আগের হাড়হিম জোড়া খুন মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনাল শিয়ালদহ আদালতের বিচারক। রাজ্য-রাজনীতি এমনকি দেশ তোলপাড় করা আরজি কর মামলায় নিহত চিকিত্সকের ধর্ষক-হত্যাকারী সঞ্জয় রাইকে যে বিচারক মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, তিনিই চিৎপুরের জোড়া খুন মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনালেন। দম্পতিকে হত্যার অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলেও মনে করছেন তিনি। ঘটনাচক্রে, এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্তের নাম সঞ্জয়। তবে পদবি ভিন্ন। দম্পতিকে হত্যার মামলায় সঞ্জয় সেন ওরফে বাপ্পার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করল সেই একই বিচারকের এজলাস।
ঘটনার সূত্রপাত:
২০১৫ সালের চিৎপুর থানা এলাকার ভয়াবহ জোড়া খুনের ঘটনায় শেষমেশ ন্যায় পেল নিহতের পরিবার এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
দশ বছর আগের ঘটনা। চিৎপুরের এক বৃদ্ধ দম্পতিকে হত্যার অভিযোগ ওঠে এক যুবকের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত সঞ্জয়কে নিজেদের সন্তানের মতো দেখতেন প্রাণগোবিন্দ দাস এবং তাঁর স্ত্রী রেণুকা দাস। উভয়েরই বয়স সত্তরের কোঠায়। বৃদ্ধ দম্পতির কন্যা আমেরিকা নিবাসী। চিৎপুরের একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তাঁদের দেখাশোনার জন্য পূর্ণিমা নামে এক তরুণী থাকতেন। পূর্ণিমার সঙ্গে সঞ্জয়ের বিয়েও দিয়েছিলেন দম্পতি। প্রাণগোবিন্দরা বাজার যাওয়া বা বাড়ির বাইরের অন্য কাজকর্মের জন্য সঞ্জয়ের উপরেই অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন। সঞ্জয়কে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সাহায্যও করতেন বৃদ্ধ দম্পতি।
খুনের বিবরণ:
পরে তদন্তে উঠে আসে লোহার রড দিয়ে আঘাত করে দম্পতিকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে সঞ্জয়ের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার দিন সকালে সঞ্জয় রিকশায় চাপিয়ে গৃহকর্তাকে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলেন। পরে আবার ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার দু’দিন পরে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে সঞ্জয়ের পৈতৃক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা অভিযুক্তকে।
শিয়ালদহের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতের রায়:
দীর্ঘ তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার পর ১ জুলাই, ২০২৫-এ শিয়ালদহের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস, অভিযুক্ত সঞ্জয় সেন ওরফে বাপ্পা-কে (৩৫) ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩৯৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
ঠিক কী হয়েছিল?
ঘটনার সূত্রপাত ১৬ জুলাই, ২০১৫-এ। দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে চিৎপুর থানার অন্তর্গত ইন্দ্রলোক হাউজিং এস্টেটের একটি ফ্ল্যাট। সেখানেই প্রবল দুর্গন্ধ বেরোয়। কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ থাকায়, পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। দরজা খুলে সেখানে প্রাণ গোবিন্দ দাস (৭৭) এবং তাঁর স্ত্রী রেনুকা দাস (৭৭) – দুইজনকেই ফ্ল্যাটের ঘরে রক্তাক্ত এবং মৃত পরে থাকতে দেখা যায়। তদন্তে পুলিস জানতে পারে খুনের সঙ্গেই প্রচুর সোনার গয়না ও নগদ অর্থ লোপাট হয়েছিল।
ওই মামলায় নিহতদের ভাগ্নে ডা. পার্থ সেনের অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা রুজু করা হয়। পোস্টমর্টেমে স্পষ্ট হয়, উভয়ের মৃত্যু পূর্ব পরিকল্পিত এবং এটি নির্মম হত্যাকাণ্ড।
আরও পড়ুন: Kalyani Horror: কল্যাণীতে কেলেঙ্কারি! উনিশের তরুণীকে লালসায় ছিঁড়েখুঁড়ে… রক্তমাখা জামা…
হোমিসাইড স্কোয়াডের তদন্ত:
হোমিসাইড স্কোয়াডের তদন্তে অভিযুক্ত সঞ্জয় সেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুসারে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম থেকে উদ্ধার হয় লুণ্ঠিত গয়না ও ₹১,৮৭,০০০ নগদ অর্থ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত লোহার পাইপ ও রক্তমাখা জামাকাপড়ও উদ্ধার হয় তাঁর বাড়ির কাছে একটি পুকুর থেকে। জানা গিয়েছে, আততায়ী ওই দম্পতির পূর্ব পরিচিত। বাপ্পাকে সন্তান স্নেহেই দেখতেন তাঁরা। বিচারক আসামির উদ্দেশে বলেন, আপনার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। জোড়া খুনের অপরাধে আপনার মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আজ, বুধবার সাজা ঘোষণা হবে।
সরকারি আইনজীবী সন্দীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘যুবকের মাছের ব্যবসা ভালো না চলায় তাকে একটি রিকশ কিনে দিয়েছিলেন ওই দম্পতি। সেই সময় ওই ফ্ল্যাটে অবারিত দ্বার ছিল বাপ্পার। তার প্রতিদান হিসেবে জুটেছে ওই নিষ্ঠুর ঘটনা। আমরা অপরাধীর চরম সাজা চাইছি।’
ফাঁসির সাজা:
মামলার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন হোমিসাইড স্কোয়াডের এসআই জগবন্ধু গড়াই। প্রায় ৩০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর আদালত অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ২ জুলাই, ২০২৫-এ রায় ঘোষণায় বলেন,
“… To Be Hanged From The Neck Until Dead” — অর্থাৎ তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করা হল।