Ei somoyer Bhabona

অবসর অভিশাপ নয়

শ্রী সুভাষ চন্দ্র মজুমদার

অবসর বাRetired আভিধানিক অর্থে কাজ থেকে অবসর নেওয়া পেশা কর্মজীবন, কাজকর্ম, পদ প্রভৃতি থেকে সরে দাড়ানো বা সরে যাওয়া ‘Retirement –অবসর গ্রহণ, নিভৃতি বা নির্জনতা’’ অভিধান থেকে সংগৃহীত অবসরের ব্যাখ্যা৷ একজন আমেরিকান লেখকের ব্যাখ্যা পেয়েছিলামRetire—মানেRe-tired মানে গাড়ীর চাকা বদলের মতো নতুন জীবনের  চলমানতায়tire চাকার উপরটা লাগানোর মত৷ অবসর নিয়ে আলোচনার শেষ নেই, কেউ কেউ বলেনwe are ageing, not getting old এবং আমার ব্যক্তিগত মতামতও তাই, আমাদের বয়স বাড়তে পারে কিন্তু আমরা কর্মজীবন থেকে অবসর নিতে পারিনা৷

                যখন ছোটো ছিলাম ভাবতাম আমরা চিরদিন এভাবেই থাকবো এবং সত্যই আমরা পৃথিবীতে দীর্ঘকাল আছি৷ সময় তার সারণীতেই চলবে এবং মোটা হবো, চোখে কম দেখবো, কানে কম শুনবো, হৃদয়ে হয়তো ছোবল খাবো এসবই আমেরিকানদের ভাষায়Senior Moments এবং আমরা সেইSenior Moments ই যাপন করছি, কিন্তু অবসর বা বর্জিত জীবন ধারা নয়৷ পৃথিবীর ৭২৭ মিলিয়ান লোক ৬৫ বছরের ওপর এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে সংখ্যাটাDr. Klein Gunt এর মন্তব্য“Because knowledge is power what can we expect as we get older and new, do we make the best of it? আমাদের অবসরSenior Moments উদযাপনের সময়৷ এই উদযাপনের কাল হবে আমাদের প্রাচীন কথায় ‘‘ত্যাক্তেন ভূঞ্জীতা’’ ও অনেক কিছু ছাড়তে হবে এবং ছাড়তে শিখতে হবে৷

                প্রথমেই ছাড়লাম কর্মময় জীবনের বাঁধাধরা সময়-নির্ঘন্ট৷ অকস্মাৎ যেন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, জীবন কাব্যে ছন্দপতন ঘটল, প্রতিটি পদক্ষেপের নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, চোখের সামনে আকস্মিক শূন্যতা আর যেন কিছু করবার নেই, মনের মধ্যে ধূ ধূ চোখে হতাশার ঘোর, এক এক জনের চিরন্তন প্রশ্ণ সময় কীভাবে কাটছে? সেই চিরন্তন উত্তর ‘‘সময় আর কাটে না’’ আর এই একই প্রশ্ণোত্তর জীবনের সর্বব্যাপী দীর্ঘ কর্মজীবন থেকে আমাকেও অবসর নিতে হয়েছে সবার মতো৷ প্রতিটি পল ঘন্টা মেপে মেপে কেটে গেছে সময়ের শেকলটায় কোনো ফাঁক ছিল না৷ অবসরের মুখ দেখিনি কখনও ভাবতে পারিনি সে মুখে কতখানি বিরক্তি কতখানি নিরানন্দ৷ আজ যখন সেই অবসর এল আমার কাছে তার আপাতকরাল মুর্ত্তি নিয়ে তখন তার মুখ দেখে প্রথমটায় আমিও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম৷ এ কী ভয়াবহ শূন্যতা, এ কি দুর্বহ অবসাদ, কী দুর্বিসহ নৈরাশ্য বুঝলাম এরূপ আমার কল্পনায় ছিলনা৷ আজ আর কাজ নেই এসেছে অবকাশ৷

                এই অবসরের ফাঁকে আমার মনটাকে অধিকার করলো এক বোধশক্তি, অন্য এক জগতের কথা যা কেজো পৃথিবীর উর্দ্ধে, যা জাগতিক প্রয়োজনকে ছাপিয়ে ওঠে৷ এই অবকাশ, বুদ্ধির অনুশাসন দিয়ে আমার চৈতন্যকে শাসন করার সুযোগ এসে গেলো৷ দেখছি অবসরের অন্য এক মূর্ত্তি, অন্য এক রূপ৷ অনুভব করতে লাগলাম অবসর নিতান্ত অবহেলার বিষয় নয়৷ অবসর মুহুর্ত্তকে করে তোলা যেতে পারে অতুল ফল-প্রসারী অবসরের ফসল আমাদের চারপাশ করে তুলতে পারে বিপূল ঐশ্বর্ষ্যশালিনী৷

                দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা দেশের ও দশের উন্নতি সম্ভব হতে পারে কিন্তু তার শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য গড়ে ওঠে মানুষের অবসাদের ভিতের ওপর দাড়িয়ে৷ অবসর শিল্প সৃষ্টির জনক৷ অবশ্যই শ্রম আর অবসর দুটিরই প্রয়োজন সমান৷ শ্রম পৃথিবীর বাস্তব রূপটী গড়ে তোলে আর অবসর সেই রূপের ওপর এনে দেয় রসের প্রলাপ৷ এই রূপ আর রসের সার্থক মিলনই জীবনের পরিপূর্ণতা৷ রুটী মানুষকে দিয়েছে বেঁচে থাকার রসদ আর  শিল্প-সংস্কৃতি দিয়েছে বেঁচে থাকার আনন্দ আর এই আনন্দের বড় উৎস হল অবসর বা অবকাশ৷

                গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারার সূত্র ধরেই আমরা জানতে পারি অবসরের মধ্যেই সর্বাঙ্গ সুন্দর সাহিত্যের বিকাশ৷ ‘‘শিল্প-কাব্য-সাহিত্য নির্জনতার ফসল আর অবসর হল এই নির্জনতার স্রষ্টা৷ আত্মপ্রকাশের তাগিদে অর্ন্তমুখী আর এই অর্ন্তমুখী মন ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে এখানে ব্যস্ততার অবকাশ নেই’’ কবির কথায় আরও পাই ‘‘অকাজের কাজ যত আলস্যের সহস্র সঞ্চয়’’ আর এই আলস্যের সঞ্চয় গুলোই তো পৃথিবীকে করে তোলে রমণীয়, রূপ, রস, গন্ধে ভরপুর৷

                বিধান পার্কের পুকুরপাড়ে পদচারনা করতে করতে আমার মনে হল আমার জীবনে সেই অবসর এসেছে৷ সক্রেটিসের ভাষায় যা ‘‘সমস্ত সম্পদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ৷’’ আজ আর সেই নিষ্ঠুর মমতাহীন সীমাবদ্ধ পথে বিচরণ করতে হবে না৷ এই অর্কমন্য মনটা এখন সৃষ্টির কাজে মেতে উঠতে পারে—আর এটা মোটেই অগৌরবের নয়৷ এই অবসর গুরুদেবের মতই বলতে পারে৷

                                                                                ‘‘মগ্ণ হলাম আনন্দময়

                                                                                                অগাধ অগৌরবে

                                                                                পাখির গানে, বাঁশির তানে

                                                                                                কম্পিত পল্লবে৷৷’’

 

২৬শে জুলাই, ২০২৩

Exit mobile version