তালিকাটা খুব ছোট নয়। গৃহস্থালির আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের তালিকা। সেন্টার টেবিল সমেত সোফাসেট, ৬টি চেয়ার-সহ ডাইনিং টেবিল, রেফ্রিজারেটর, স্প্লিট এসি, গদি সমেত ৭ ফুট লম্বা ও ৬ ফুট চওড়া খাট, দু’টি বেডসাইড টেবিল, ওয়াশিং মেশিন, এলইডি টিভি। নতুন নয়, ৬ মাসের পুরোনো। কিন্তু এই সব ক’টা জিনিসের মোট দাম? মাত্র ৫০ হাজার টাকা।
তার সঙ্গে ফ্রি-ডেলিভারি সিআরপিফের ট্রাকে করে। কারণ, ‘দুর্গাপুরে পোস্টেড সিআরপিএফের কম্যান্ডান্ট আশিস কুমার’ হঠাৎই বদলি হয়ে যাচ্ছেন ভিন রাজ্যে এবং সেখানে যাওয়ার আগে তিনি ওই সব জিনিস বিক্রি করে দিতে চাইছেন নামমাত্র দামে। কিন্তু মিথ্যে। আসলে এমনটা বলে প্রলোভন দেখিয়ে পাতা হচ্ছে প্রতারণার ফাঁদ। এবং এটা হচ্ছে কলকাতা পুলিশের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তার ‘রেফারেন্স’-এ। প্রতারণার প্রথম ও প্রধান ধাপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুককে।
মঙ্গলবার লালবাজারের সাইবার ক্রাইম থানায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা, কাশীপুর এলাকার বাসিন্দা অনিল জানা এই ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেছেন। সাম্প্রতিক কালে প্রতারকরা ফেসবুকে কোনও পুলিশকর্তা বা আধাসেনা কর্তা কিংবা সেনাকর্তার ভুয়ো প্রোফাইল খুলে মেসেঞ্জারে বার্তা দিয়ে টাকা ধার চেয়ে অথবা সেকেন্ড হ্যান্ড সামগ্রী সস্তায় বেচার প্রস্তাব দিয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে।
কলকাতা পুলিশ থেকে সহকারী কমিশনার পদে ২০১২ সালে অবসর নেওয়া অনিল জানার ভুয়ো ফেসবুক-অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার যে জাল পাতা হয়েছে, তা কিছুটা অভিনব। প্রথমে ওই ভুয়ো প্রোফাইল থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তার বহু পরিচিতকে। খেয়াল না-করে অনেকেই সেই রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করছেন।
প্রথমে ফেসবুক মেসেঞ্জারে শুরু হচ্ছে কুশল বিনিময়। তার পরেই মোবাইল নম্বর চাওয়া হচ্ছে- পুরোনো ফোন বদল করায় সব কনট্যাক্ট হারিয়ে গিয়েছে, এই অছিলায়। তার পর নকল অনিল জানা ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানাচ্ছেন, ওই তথাকথিত সিআরপিএফ কম্যান্ডান্টের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা ও জলের দরে গৃহস্থালির জিনিসপত্র বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে আধাসেনা অফিসারের বদলি হওয়ার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি।
পরিকল্পনা মতো ওই ভুয়ো সিআরপিএফ অফিসারের ফোন যাচ্ছে অনিল জানার পরিচিতদের কাছে। তার পর তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হচ্ছে আসবাব ও বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ছবি। তবে ব্যাপারটা যে গোলমেলে, সেটা প্রথম ধরে ফেলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তার এক আত্মীয়। তিনি জানান, আসবাব ও বৈদ্যুতিন সরঞ্জামগুলো যে ৬ মাসের পুরোনো, সেটা তিনি নিশ্চিত হবেন রসিদ দেখার পর। সেটা তাঁকে শেষমেশ পাঠানো হয়নি। তিনি এবং অনিল জানার আরও কয়েক জন পরিচিতের সন্দেহ হওয়ায় তাঁরাও বিষয়টি ওই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তাকে জানান।
লালবাজারের গোয়েন্দারা জেনেছেন, গত ২২ মার্চ সকালে নিজের বাড়ির অদূরেই অনিল জানার মোবাইল ফোনটি তাঁর পকেট থেকে পড়ে যায়। ওই ফোন প্রতারকদের হাতে পড়াতেই বিপত্তি বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। তদন্তকারীরা অনিল জানার ভুয়ো ফেসবুক প্রোফাইলটি বন্ধ করানোর বন্দোবস্ত করছেন এবং চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন ওই ভুয়ো আধাসেনা কর্তাকে। প্রাক্তন সহকারী পুলিশ কমিশনার অনিল জানা বলছেন, ‘গোটা চাকরি জীবনে বহু দুষ্কৃতীকে ধরেছি। আর এখন কি না আমারই পরিচয় ভাঁড়িয়ে প্রতারণার ছক কষা হলো!’