লকডাউনের সেই ঘরবন্দি দশা আর নেই। খুলেছে স্কুল-কলেজও। কিন্তু লকডাউনের সময়ে কেমন পড়াশোনা করেছিল স্কুল পড়ুয়ারা? এই প্রশ্নটাকে সামনে রেখেই করা হয়েছিল একটি সমীক্ষা। আর তার রিপোর্ট বলছে, বাংলার পড়ুয়া ও শিক্ষকরা চেষ্টা করেছিলেন, তবে দীর্ঘ প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় মোবাইল ফোনের অভাব, ইন্টারনেটের অপ্রতুলতা এবং অন্যান্য বিভিন্ন বাধার কারণে পড়াশোনা কার্যত লাটে উঠেছিল।
স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুলের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমীক্ষকদের দাবি, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের বিভিন্ন অংশেই বহু পড়ুয়া স্কুলছুট হয়েছে। কিন্তু তার আসল সংখ্যা বার করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে বাংলায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা চলতি বছরে এক ধাক্কায় প্রায় ৪ লক্ষ কমেছে। সমীক্ষকদের দাবি, এর অন্যতম কারণ হলো, কোভিড পরিস্থিতি।
২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হয়েছে এই সমীক্ষা। পৃথিবীর অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভারতের দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এই সমীক্ষা হয়েছিল। সমীক্ষকদের বক্তব্য, উত্তরপ্রদেশের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গে এই সমীক্ষার কাজ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। ইংল্যান্ডের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে হওয়া এই সমীক্ষার প্রথম পর্বের রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গত বুধবার, ৩ মে সমীক্ষকরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনাতেও বসেন।
সমীক্ষা-রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার ভয়ঙ্কর ঘাটতি এবং সেই সম্পর্কিত ভবিষ্যৎ আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। গত বছরের ১০,৯৮,৭৭৫ পরীক্ষার্থীর তুলনায় এই বছর মাত্র ৬,৯৮,৬২৮ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে। প্রাথমিক ভাবে গত দু’বছরে পশ্চিমবঙ্গে অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষার অপরিণত ব্যবস্থাপনাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।’
তা ছাড়া, শিক্ষা ও প্রযুক্তির লভ্যতা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশাল বৈষম্য ছিল। অনলাইন শিক্ষণে পারদর্শিতার অভাব, বৈদ্যুতিন পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে অতিমারী চলাকালীন মূলত শিশুদের, বিশেষত মেয়েদের শিক্ষা বিপন্ন হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন শহরেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের স্কুলছুট অনেক বেশি।
অনেকেরই দাবি, এর ফলে অপরিণত বয়সে স্কুলছাত্রীদের বিয়ের সংখ্যাও করোনাকাল এবং তার পর অনেকটা বেড়েছে। যে শিক্ষকরা ওই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা জানিয়েছেন, মুখোমুখি ক্লাস না-হওয়ায় পড়ুয়াদের অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব হয়নি। পড়ুয়ারা অনলাইন ক্লাসে ৫-১০ মিনিটের বেশি মনঃসংযোগ করতে পারেনি। কোনও প্রশ্ন করা হলে ক্লাসের অধিকাংশ পড়ুয়াই সঠিক উত্তরের জন্য ক্লাস টপারের দিকে চেয়ে থাকত। সে কিছু বললে সেটাই অন্যেরা আউড়ে যেত- এমনটা বলা হয়েছে সমীক্ষায়।
রাজ্য সরকার ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ আগেই জানিয়েছিল, এই বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা যখন প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়, সে বার কঠোর ভাবে ন্যূনতম বয়ঃসীমা মানা হয়েছিল। তাই, সেই সংখ্যা প্রথম শ্রেণিতেই অনেকটা কমে যায়। সুরঞ্জনের বক্তব্য, ‘এটা যেমন একটা কারণ হতে পারে, তেমনই স্কুলছুটেরও ইঙ্গিত এই সমীক্ষা থেকে পাওয়া যাচ্ছে।’
তবে একই সঙ্গে সুরঞ্জন জানাচ্ছেন, স্কুল বন্ধ থাকাকালীন রাজ্য সরকারের উদ্যোগে টিভি-তে পড়াশোনা, পাড়ায় শিক্ষালয়, মিড-ডে মিল এবং দ্বাদশের পড়ুয়াদের ট্যাব দেওয়ার মতো উদ্যোগ যথেষ্ট কাজে এসেছে। অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য গবেষক সুনৃতা ধর ভট্টাচার্য জানান, উত্তরপ্রদেশে ডিজিটাল বৈষম্য, শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাসে পারদর্শিতার অভাব, মিড-ডে মিলে বৈষম্যের মতো বিভিন্ন বিষয় সমীক্ষায় উঠে এসেছে। দিল্লিতেও ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরাই অনলাইন ক্লাসের সুযোগ সব চেয়ে বেশি নিতে পেরেছে- এমনটা ওই সমীক্ষায় ধরা পড়েছে।