নৈহাটি স্টেশনে উনি পরিচিত মুখ। লোকাল ট্রেন দাঁড়াতেই হাত ধরে ওঁকে ট্রেনে উঠতে সাহায্য করার যাত্রীর অভাব হয় না। কামরায় যত ভিড়ই থাকুক, ঠিক একটা সিট পেয়ে যাবেন তিনি। সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাকি পথটা পেরিয়ে সোজা শিয়ালদহ স্টেশনে। পরিতোষ বিশ্বাসকে তো দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু ওঁর গলা শুনেছেন আরও বহু গুণ বেশি মানুষ। যদিও খুব কম জনই জানেন পরিচিত পরিতোষের গলাই তাঁরা রোজ শোনেন শিয়ালদহ স্টেশনের মাইকে।
‘একটি বিশেষ ঘোষণা, ১১টা ৪৫ মিনিটের বনগাঁ লোকাল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে’, শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রীদের ভিড় ছুটল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। ‘ডাউন ট্রেন দেরিতে আসার জন্য নৈহাটি লোকাল ছাড়তে দেরি হচ্ছে’ ঘোষণা ভেসে আসতেই বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলো হাজারদু’য়েক মুখে। সকলের চোখের আড়ালে বসে যিনি এমন ঘোষণা করে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ যাত্রীকে দিশা দেখিয়ে চলেছেন, চলতি মাসে সেই পরিতোষ বিশ্বাসের চাকরিজীবনের ৩৪ বছর পূর্ণ হলো বলে জানাচ্ছে পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশন।
তবে পূর্ব রেলের বাকি ঘোষকদের সঙ্গে পরিতোষ বিশ্বাসের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। যাত্রীদের দিশা দেখালেও পরিতোষ নিজে দৃষ্টিহীন। কালো চশমা আর হোয়াইট কেনের (দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ লাঠি) সাহায্যে গত প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে ডিউটি সামলে আসছেন। বাকিদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ আসে লিখিত অর্ডারে। কিন্তু পরিতোষ? পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র বলছেন, ‘উনি সবটাই শুনে মনে রাখেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঁর স্মৃতিশক্তি যেন আরও সতেজ হয়ে উঠছে। প্রতিটি রুট, ট্রেন, ট্রেনের নম্বর, প্ল্যাটফর্ম নম্বর – সব উনি শুনে মনে রাখেন এবং সেইমতো ঘোষণা করেন।’
প্রায় সাড়ে তিন দশকের চাকরিজীবন পেরিয়ে পরিতোষ বলছেন, ‘ভারতীয় রেল, বিশেষ করে পূর্ব রেলের কাছে কৃতজ্ঞ। যখন কর্মজীবন শুরু করেছিলাম তখন লড়াই সত্যিই কঠিন ছিল। এখন মানসিকতা অনেক বদলেছে। সেই সময়ে পূর্ব রেল আমার উপরে আস্থা রেখেছিল। আমার সহকর্মীদেরও ধন্যবাদ।’
পূর্ব রেল জানাচ্ছে, ১৯৮৯ সাল থেকে রেলে কাজ করছেন পরিতোষ। প্রথমে শিয়ালদহে কিছু দিন কাজ করার পর তাঁকে নৈহাটিতে বদলি করা হয়। এর পর তিনি ফের শিয়ালদহে আসেন। রঙিন দুনিয়া দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেও তিনি শুধু স্পর্শের জোরে মোবাইল এবং অন্য বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গ্যাজেট ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ। ব্রেইল পদ্ধতিতেও অভ্যস্ত। চাকরিজীবনের ৩৪ বছর পূর্ণ হওয়ায় তাঁকে পূর্ব রেলের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার অমরপ্রকাশ দ্বিবেদীর বক্তব্য, ‘পরিতোষের জীবন প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের বিজ্ঞাপন।’