এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি খোঁজখবর শুরু করতেই ঘটনার দশ দিন পর বুধবার রাধিকাকে দেখতে ওঁর বাড়িতে গেলেন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক। তাঁকে এইমসে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। ঘরের লোক প্রার্থী হয়েছে বলে কথা! অনেকটা সক্রিয় হয়ে ভোটের দিন গ্রামের কয়েকজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে দিনহাটার ৭/২৬২ নম্বর বুথের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রাধিকা। হঠাৎ দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলি এসে লাগে তাঁর পাঁজরে।
রাধিকার জা বিজলি বর্মন বলেন, ‘চিকিৎসকরা অপারেশনের পরে জানিয়েছেন, পাঁজরের গুলি বের করতে গেলে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া, বড় অপারেশনের জন্য বড় খরচ। ওর স্বামী বেঙ্গালুরুতে দিনমজুরের কাজ করে। তাই রাধিকাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। অভাবের সংসারে চিকিৎসার খরচ কী করে জোগাড় করব? নেতারা একবার ফোন করে দায় সেরেছেন।’ ভাসুর বুলু বর্মন শেষ পর্যন্ত ভোটে জিতেছেন। কিন্তু ভাইয়ের বৌকে নিয়ে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। মন্ত্রীর আশ্বাসে ভরসা করতে হচ্ছে আপাতত তাঁকে।
ভোটের দিন বুথে গোলমালের জেরে গুলিবিদ্ধ হন মালদার রতুয়ার দেবীপুর অঞ্চলের হরিণখোল গ্রামের সিপিএম সমর্থক মাইনুল হক। তাঁর পিঠে গুলি লাগে। দলের সদস্যপদ না-থাকলেও পার্টি অন্ত প্রাণ। মালদা মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে গত সপ্তাহে বাড়ি ফিরেছেন বটে, তবে এখনও শয্যাশায়ী। বাঁচবেন কি না সবটাই এখন উপরআলার হাতে।
৩ সন্তান, স্ত্রীকে নিয়ে ৬ জনের পরিবার। খেতমজুর মাইনুল কী করবেন বুঝতে পারছেন না। পরিবারে তিনিই একমাত্র রোজগেরে। ফলে আর্থিক অনটনে পড়েছেন। সেই সময়ে সিপিএম নেতারা হাসপাতালে অনেক ছুটোছুটি করেছিলেন। কিছুটা আর্থিক সাহায্যও দিয়েছিলেন। তবে খরচের বেশিরভাগটাই চড়া সুদে জোগাড় করেছেন। স্থানীয় সিপিএম নেতা আফসার আলি স্বীকার করেছেন, ‘মাঝে মাঝে কিছু পথ্য ও নগদ টাকা দিয়ে দল সাহায্য করার চেষ্টা করলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।’
নিজের মতামত প্রয়োগ করতে গিয়ে ভোটের দিন সংঘর্ষের পরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন অন্তত ২০০ জন। ইসলামপুরের সফিক শেখ তাঁদের একজন। গুরুতর আহত হয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ৮ দিন ভর্তি থাকার পর সদ্য বাড়ি ফিরেছেন। দিন আনি দিন খাই পরিবারের সফিক অসুস্থ হওয়ায় অনটনের অশান্তি শুরু হয়েছে।
খিদের জ্বালায় ৮ বছরের ছেলের কান্না ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর কষ্টের কান্নাকে। মঙ্গলবার সফিক বলেন, ‘দল অত খরচ দেবে কী করে? তবুও যে পাশে থেকেছে এটাই সান্ত্বনা।’ রানিনগর ২ ব্লকের কংগ্রেস কর্মী ইনতাজুল বিশ্বাসও গুরুতর আহত হয়েছিলেন ভোটের দিন। মেডিক্যাল কলেজে কয়েকদিন ভর্তি থাকার পরে তিনিও ফিরে গিয়েছেন বাড়িতে। যে কোপ খেয়েছেন তা সারতে আরও এক মাস। এখন কষ্টের কোপে সংসার। ইনতাজুল বলেন, ‘ভোটে আমাদের এখানে প্রচুর কংগ্রেস কর্মী আহত হয়েছিলেন। কতজনকে পার্টি দেখবে?’
ভোট গণনার দিন উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর গণনা কেন্দ্রের সামনে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর লাঠির ঘায়ে পা ভেঙেছিল মাঝিয়ালি অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি আকবর আলির। তিনি এখন মুম্বইতে চিকিৎসাধীন। জানা গিয়েছে, পার্টি পাশে থাকলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারের উদ্যোগেই তাঁকে মুম্বই নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসার খরচও পরিবারকেই সামলাতে হচ্ছে।
মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া ছররা গুলি লেগেছিল ইসলামপুরের সিপিএম কর্মী হাজিমুল ইসলামের চোখে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে যেতে হয় নেপালে। ক্রমশ সুস্থ হওয়ার পথে তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘নেপাল যাওয়া-আসা ও চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করেছে পার্টি। কিন্তু জখম হয়ে বাড়িতে বসে থাকার জন্য উপার্জনের পথ এখন বন্ধ। এই ক্ষতি পূরণ হবে কী করে?’ হাজিমুলের পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘চিকিৎসার খরচ পার্টি দিয়েছে। কিছুদিন হয়তো অন্য সাহায্যও পাওয়া যাবে। কিন্তু সারা জীবন তো আর পার্টি দেখবে না। তখন।’
(তথ্য–প্রবীর কুণ্ডু, রণবীর দেব অধিকারী, মানস রায় ও শীর্ষেন্দু গোস্বামী)