অভিশপ্ত সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিলেন ফার্স্ট ইয়ারের ওই পড়ুয়া। নদিয়ার মৃত ছাত্রের মতো তিনিও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলেই উঠেছিলেন সিনিয়রদের হাত ধরে। তারপর গত বুধবার রাতে হস্টেলের তিন তলা থেকে ছাত্রের পড়ে যাওয়ার পরে প্রথম বর্ষের বাকি পড়ুয়াদের প্রায় ১৭-১৮ ঘণ্টা কার্যত ‘পণবন্দি’ করে রাখা হয় বলে অভিযোগ। একটি ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে তাঁদের আটকে রাখে সিনিয়ররা। তেমনই এক পড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলেছে ‘এই সময়।’ নিরাপত্তার খাতিরে তিনি নিজের নাম, বিভাগের নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে তাঁর বয়ানে উঠে এসেছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির সামনেও জবানবন্দি দিয়েছেন প্রথম বর্ষের জনা পাঁচেক পড়ুয়া। তাঁদের বয়ানের সঙ্গে এই পড়ুয়ার অভিজ্ঞতায় অনেক মিল রয়েছে বলে সূত্রের খবর।
ওই ছাত্রের দাবি, নদিয়ার পড়ুয়া যে দিন হস্টেলে আসেন, তার একদিন আগে তিনিও হস্টেলে ঢোকেন। প্রথম রাত কোনওক্রমে কাটলেও দ্বিতীয় রাত থেকে শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। সিনিয়রদের কাছে ইন্ট্রো (নিজের পরিচয়) দেওয়ার নাম করে চলতে থাকে র্যাগিং। ওই ছাত্রের কথায়, ‘অন্তর্বাস পরিয়ে আমার কাছেও সেই রাতে ইন্ট্রো নিচ্ছিল একদল সিনিয়র। আমার গোপনাঙ্গের মাপ জানতে স্কেল নিয়ে ওরা মাপছিল। আর তখনই, রাত সাড়ে ১১টার কিছু আশেপাশে একটা চিৎকার শুনতে পাই।’ তখন ওই পড়ুয়া-সহ বাকি সিনিয়ররা হস্টেলের করিডরে এসে জানতে পারেন একজন উপর থেকে নীচে পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু প্রথম বর্ষের বাকি পড়ুয়াদের কাছে তখনও স্পষ্ট হয়নি, কে পড়েছেন।
ওই ছাত্রের কথায়, ‘আমরা যখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি, তখন এক সিনিয়র কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে নীচ থেকে উঠে আসে। চিৎকার করে বাকিদের বলে, সব ফার্স্ট ইয়ারকে একটা ঘরে ঢোকা। কেউ যেন বাইরে না যায়।’ নীচে তখন রক্তাক্ত পড়ে আছেন এক ছাত্র। অথচ সিনিয়ররা জোর করে হস্টেলের একটি ঘরে প্রথম বর্ষের বাকি পড়ুয়াদের ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ।
ওই ছাত্রের কথায়, ‘আমাদের চিনতে অসুবিধে ছিল না, কারণ হস্টেল বাপদের বলে দেওয়া নিয়মে আমাদের মিলিটারি ছাঁটের চুল কাটতে হয়েছিল। তাই যাদেরই চুল ওই ভাবে ছাঁটা, তাদেরই ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।’ ওই পড়ুয়ার দাবি, অন্তত ১৩-১৪ জন ফার্স্ট ইয়ারকে ঘরে ঢুকিয়ে তাঁদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। বলা হয়, কাউকে কিছু বলা যাবে না। ঘরে পাহারায় বসে পড়ে দু’জন সিনিয়র আবাসিক ছাত্রও।
ওই পড়ুয়ার দাবি অনুযায়ী, এরপর হস্টেলের বাইরে বা অন্য জায়গায় কী হয়েছে সেটা তাঁরা কেউই জানতে পারেননি। রাত যখন অনেক, তখন সিনিয়রদের একটি দল ঘরে ঢুকে আসে। ছাত্রের দাবি, ‘পরে আমি খবরে ছবি দেখে বুঝলাম যাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে, তারাও অনেকে সেই দলে ছিল।’ ঘরে ঢুকেই হম্বিতম্বি-শাসানি শুরু হয় প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের উপরে। ওই ছাত্রের কথায়, ‘আমাদের বলা হয় হস্টেলে একটা ছেলে উপর থেকে নীচে পড়ে গিয়েছে। আমরা চাই না আর কোনও জুনিয়রদের সঙ্গে এমন কিছু ঘটুক। সিনিয়ররাই নাকি আমাদের প্রোটেকশন দেবে। কিন্তু এটা হস্টেলের ব্যাপার, বাইরে যেন লিক না হয়।’
ওই পড়ুয়ার সংযোজন, ‘এরপর ওরা চলে যায়। জিবি মিটিং করে আবার ফিরে এসে আমাদের শাসায়। এবং বলে, জিবিতে ঠিক হয়েছে, কোনও ফার্স্ট ইয়ার হস্টেলের বাইরে আগামী কয়েক দিন বেরোতে পারবে না। মিডিয়া, পুলিশ বা বাকিদের কাছে মুখ খোলা যাবে না।’ ছাত্রের বয়ান অনুযায়ী, এরপর বলা হয়, বাইরে বলতে হবে মৃত পড়ুয়াকে ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের ভয় দেখানো হয়েছিল। তাই তিনি হস্টেলে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। সিনিয়ররা অনেক বুঝিয়েও সামলাতে পারেননি। অবশেষে ওই ছাত্রে নিজেই তিনতলা থেকে ঝাঁপ দেন।
ঘরে আটকানো প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের বাইরে বেরোতে দেওয়া হয়নি। টয়লেটেও নয়, যতক্ষণ না দু-চারজনের এক সঙ্গে প্রয়োজন পড়ছে। সেখানেও সিনিয়ররা পাহারা দিয়েছিলেন। তবে খাবারদাবার সব ঘরেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। ওই ছাত্রের কথায়, ‘পরদিন বিকেলে যখন টিচাররা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখন মনে হলো অন্তত প্রাণে বেঁচে যাব। আমরা কেউ ভয়ে মুখ খুলিনি ঠিকই। কিন্তু ওঁরা আমাদের দেখে সব বুঝতে পেরেছিলেন।’
নদিয়া থেকে আসা ছাত্রটির মৃত্যুর পরের দিন, অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের উদ্ধার করতে হস্টেলে ছুটে যান শিক্ষকদের একটি দল। সেই দলে ছিলেন অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী। তাঁর কথায়, ‘আমরা গিয়ে দেখলাম গাদাগাদি করে প্রথম বর্ষের পড়ুয়ারা একটা ঘরে আটকে রয়েছে। ওদের চোখে মুখে ভয় আর আতঙ্ক। কেউ মুখ খোলেনি। আমরা তখনকার মতো ওদের ফোন নম্বর দিয়ে আসি।’ পরে এই শিক্ষকরাই ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়ের উপর চাপ তৈরি করেন। রজত এরপর হস্টেল থেকে প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের বের করার নির্দেশিকা জারি করেন। এ দিন রজত আর এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।