দিল্লি পুলিশ, মুম্বই পুলিশ, সিবিআইয়ের পরে এবার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট! কেন্দ্রীয় এজেন্সির নাম এবং লেটার হেড ব্যবহার করে সাইবার প্রতারকরা এক অধ্যাপকের থেকে হাতিয়ে নিয়েছে দু’লক্ষ ১০ হাজার টাকা। এখানেই শেষ নয়, এই প্রতারণার কাজে নিখুঁত ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও (এআই)! যেখানে উত্তরপ্রদেশের আইপিএস কর্তা আকাশ কুলহারির ভিডিয়ো ফুটেজের সঙ্গে তাঁরই গলার স্বর মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে হুমকি-বার্তা। এরপর স্কাইপের সাহায্য নিয়ে তা শোনানো হয়েছে অধ্যাপক অর্কমিত্র করকে। একদম নতুন ট্রেন্ডের এই প্রতারণায় হতবাক হয়ে গিয়েছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরাও। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
ঠিক কী ঘটেছিল অর্কমিত্রের সঙ্গে?
রবিবার মুম্বইয়ের একটি ক্যুরিয়ার সংস্থা থেকে আচমকা ফোন পান আদতে বাঁশদ্রোণীর বাসিন্দা, বর্তমানে বিআইটিএস-পিলানি (রাজস্থান) কলেজের হায়দরাবাদ ক্যাম্পাসের অধ্যাপক অর্কমিত্র কর। বলা হয়, মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য তাঁর নাম করে একটি কনসাইনমেন্ট বুক করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ওই প্যাকেটে টাইগার স্কিনের ওয়ালেট রয়েছে। ফলে বেআইনি এই কাজের জন্য মুম্বই পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। সম্ভবত তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হবে। নেহাতই ফিচলেমি মনে করে অধ্যাপক কর বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্ব দেননি। তবে ভুল ভেঙে যেতে বেশি সময় লাগেনি।
দশ মিনিটের মধ্যে মুম্বই পুলিশের ইনস্পেক্টর সন্দীপ রাও নামে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি নিজের ব্যাচ নম্বর, আইডি এবং লোগো হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে স্কাইপের লিঙ্ক পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। স্কাইপ অন হতেই ওই ব্যক্তি সরাসরি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে আপনার সন্দেহ থাকলে গুগলে সার্চ করে পরিচয় জেনে নিতে পারেন। কিন্তু আপনি সমস্যায় পড়েছেন বলে সাবধান করতে এসেছি। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে। এখন আমাদের আর কিছু করার নেই। এরপর গ্রেপ্তারি এড়াতে হলে সিবিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’ অধ্যাপক কর ধাতস্থ হতে না হতেই হোয়াটসঅ্যাপে চলে আসে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের একটি নোটিস।
যেখানে বলা হয়েছে, তিনি মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রুজু হয়েছে মামলা। এবার চিন্তায় পড়ে যান অর্কমিত্র। কিছু ভেবে ওঠার আগেই ফোনে চলে আসে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের লেটারহেড ব্যবহার করে একটি ওয়ারেন্ট। এরপর কার্যত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অসহায় ওই অধ্যাপক। কিন্তু কী করবেন ভাবতে না ভাবতে তাঁর মোবাইলে ফের কল চলে আসে নিজেকে সিবিআই অফিসার হিসেবে পরিচয় দেওয়া উত্তরপ্রদেশের আইপিএস অফিসার আকাশ কুলহারির।
স্কাইপের মাধ্যমে অন্য প্রান্ত থেকে তিনি বলতে থাকেন, ‘আপনি খুব বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন। বিকেল পাঁচটার মধ্যে পাঁচ লক্ষ টাকা সিকিউরিটি মানি না দিলে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আটকানো যাবে না।’ অর্ক তাঁকে বলেন, ‘আমার অ্যাকাউন্টে এত টাকা নেই।’ ছদ্মবেশী আকাশ এরপর হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং-এর প্রসঙ্গ তুলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জেনে নেন। প্রথম দফায় এক লক্ষ টাকা। এরপর রেভিনিউ ফান্ডের নাম করে আরও ৮৮ হাজার টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ফোন করে আইনজীবীর ফি বাবদ চাওয়া হয় আরও তিরিশ হাজার টাকা। তা-ও দিয়ে দেন অর্ক।
এরপর কী হয়েছিল?
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে এই জেরা এবং টাকা আদায় পর্ব শেষ হওয়ার পরে আচমকা ও-প্রান্তের মোবাইলগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ইনভ্যালিড হয়ে যায় স্কাইপের লিঙ্কও। তড়িঘড়ি এক সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন অর্ক। আতঙ্কের ঘোর কাটার পরে দেখতে পান তাঁর পাঠানো টাকা আসলে জমা পড়েছে মেসার্স এমকে ট্রেডার্স নামে একটি সংস্থায়। এমনকী সুপ্রিম কোর্টের নামে যে নোটিস পাঠানো হয়েছিল, তা-ও ভুয়ো। তবে চমকের এখানেই শেষ নয়, আকাশ কুলহারির নামে ইউটিউবে সার্চ করতেই দেখা যায় তিনি আদৌ সিবিআইয়ে কর্মরত নন। বরং ইউটিউবে তাঁর ২৩ মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে। যেখান থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে তাঁর ভয়েসকে এআই-এর সাহায্য নিয়ে লিপ সিঙ্ক করিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে অর্ককে। আদায় করা হয়েছে লক্ষাধিক টাকা।
দ্রুত তেলঙ্গানা পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। বিষয়টি জানান কলকাতার একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ককেও। বুধবার অর্কমিত্র বলেন, ‘বিষয়টি এত দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছিল যে, মাথা কাজ করছিল না। পুরো রোবটের মতো যেন নির্দেশ পালন করে যাচ্ছিলাম। সকলকে বলব আমার মতো ভুল যেন না করে।’