সূর্য ডুবে গেল। ওই যে ইমলিবাবা ডাকছে বালকিষণ…বালকিষণ…বালকিষণ। সত্যজিৎ রায়ের ভূতের গল্প খগম-এর শেষটা মনে পড়ছে তো। শরীরে ভয়ের শিরশিরানি তৈরি করে শেষ হয় যে গল্প।
আবার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোঁসাইবাগানের ভূতের সেই নিধিরাম। বুরুনকে ভয় দেখাতে ব্যর্থ হয়ে যে হতাশায় ডুবে গিয়েছিল। এর সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ডমরুচরিতে ভূত নিয়ে ম্যাজিক্যাল ফ্যান্টাসি। কিংবা পরশুরামের ভূশন্ডীর মাঠের শেষে শিবুর তিন জন্মের স্ত্রী আর নৃত্যকালীর তিন জন্মের স্বামীর ডবল ত্র্যহস্পর্শযোগের যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্য তো বটেই সম্ভবত বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল।
বিশ্ব সাহিত্যে কী ভাবে এসেছে ভূত? বিশেষ করে ব্রিটিশ এবং মার্কিন সাহিত্যে? সেখানেও কি রয়েছে শাকচুন্নি, পেত্নি, বেহ্মদত্যি কিংবা গুপি গাইন বাঘা বাইনের বাবা ভূত, ছানা ভূতেরা? সে দেশেও কি ভূতের রাজা গান শুনতে পছন্দ করেন? গান ভালো লাগলে বর দেন? এমন হাজারো প্রশ্ন থাকলেও তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা বা গবেষণা হয়নি এ বঙ্গে। এবার সেই কাজ শুরু করল কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
চলতি মাসের ১২ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হয় ভূতের গল্পের সেমিনার। প্রথম পর্যায়ের সেই সেমিনারে আলোচিত হয়েছে ব্রিটিশ ও আমেরিকার ভূত-সাহিত্য। তার জন্য সময় বাছা হয়েছে ১৭০০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল। ২৬০ বছরের ভূত সমগ্র নিয়ে কর্মশালায় যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক পড়ুয়াদের সঙ্গে মার্কিন ও ব্রিটিশ লেখকরাও। ভূত-চর্চার দ্বিতীয় পর্যায়ে বিদেশি গল্পের সঙ্গে বাংলা গল্পের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের ভাবনা-চিন্তাও শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমে ইংল্যান্ড এবং পরে আমেরিকায় ১৭০০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ভূতের উপর লেখা সেরা গল্পগুলি নিয়ে আমাদের কর্মশালায় আলোচনা করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ওই সময়কার ভূতের গল্পগুলি বাছাই করে অনুবাদের পর আমরা বাংলায় বই হিসেবে প্রকাশ করব।’ শুধু প্রকাশনা নয়, কোন পরিস্থিতি ও সামাজিক পটভূমিতে ওই গল্পগুলি লেখা হয়েছিল, তার তাৎপর্য, বর্তমান জগতে তার ভিত্তি রয়েছে কিনা তা গল্পের শেষে টিকা হিসেবে তুলে ধরা হবে।
একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ভূতুড়ে চরিত্রদের সঙ্গে মার্কিন বা ব্রিটিশ লেখকদের লেখা চরিত্রগুলির পার্থক্য বা সাদৃশ্য রয়েছে কি না তাও জানতে চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালেয়র গবেষকরা। ইংরেজি সাহিত্যের ওই অধ্যাপক বলেন, ‘বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা ভূতের গল্প লিখছেন, তাঁদের গল্প বেছে বিদেশি ভূত এবং দেশি ভূতের পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করব। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই কাজ করার ভাবনা রয়েছে।’
যোগ করছেন, ‘এই দু’টি কাজ আমরা করতে পারলে আগামী দিনে ভূতের গল্পের মাধ্যমে সমাজের নানা সমস্যা, পরিপ্রেক্ষিত এবং সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা যাবে। গল্পের চরিত্র এবং প্লটের মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের পরিবেশও উঠে আসবে।’ তিনি জানান, আগামী ডিসেম্বরে এই বিষয়ে আরও বড় ধরনের কর্মশালা করা হবে। দেশি-বিদেশি লেখক, অনুবাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রাথমিক ভাবে আমরা ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার ৪০টি গল্প বেছে অনুবাদের কাজ শুরু করেছি। ভারতে এই প্রথম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজ শুরু করল। অতীতে এ দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় ভূত নিয়ে এমন কাজ করেনি। এর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ইংরেজি সাহিত্যের বিভাগ।’
উপাচার্য জানিয়েছেন, গবেষণা শেষে দু’খণ্ডে ভূতের বই প্রকাশ করা হবে। প্রথম খণ্ডে থাকবে শিশু-কিশোরদের জন্য বাছাই করা ভূতের গল্প, দ্বিতীয় খণ্ডে থাকবে ভূত নিয়ে গবেষণায় উঠে আসা অংশ। আপাতত পাঠকরা ভূতের ভবিষ্যৎ জানতে তাকিয়ে থাকতে পারেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।