অর্ধেক আকাশের ক্ষমতায়নে লোকসভা, বিধানসভায় মহিলাদের জন্যে আসন সংরক্ষণের বিলও পাশ হয়ে গেল সংসদে। কিন্তু মহিলাদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব সমাজের কত গভীরে প্রোথিত–তা আরও এক বার সামনে এল এক মামলার সূত্রে। বিচারে নিম্ন আদালতকে লিঙ্গ বৈষম্যমূলক মানসিকতা ত্যাগের জন্যে পরামর্শ দিতে হলো হাইকোর্টকে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই শিক্ষিত, সেখানে তাঁর নামে থাকা সম্পত্তি স্বামীকে না-জানিয়ে বিক্রি করে দেওয়ায় স্ত্রীর নিষ্ঠুরতা প্রমাণ হয় না–মনে করাল হাইকোর্ট। অথচ ‘স্ত্রী নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন’ যুক্তিতেই স্বামীর পক্ষে নিম্ন আদালত ডিভোর্সের নির্দেশ জারি করেছিল।
সেই যুক্তি ও নির্দেশ খারিজ করতে গিয়ে হাইকোর্টে বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি প্রসেনজিৎ বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চের প্রশ্ন, আজ যদি ওই সম্পত্তি স্বামীর নামে থাকত, আর তিনি স্ত্রীকে না জানিয়ে তা বিক্রি করতেন, তা হলে কি সেই আচরণকে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নিষ্ঠুরতা হিসেবে দেখা হতো? এর পরেই ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতকে লিঙ্গ বৈষম্যমূলক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয়। ডিভিশন বেঞ্চের স্পষ্ট বক্তব্য, আজকের সমাজেও নারীর উপরে পুরুষ আধিপত্য দেখাবে, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানেও নারী-পুরুষ সমান।
১৯৯০ সালে বিয়ের পর স্ত্রীর নামে দুর্গাপুরে একটি বড় জমি কিনেছিলেন স্বামী। তবে অচিরেই দাম্পত্য কলহ শুরু হয় বলে দাবি স্বামীর। কিছু মাস পরে সেই জমি স্বামীকে না জানিয়ে স্ত্রী বিক্রি করে দেন। পরবর্তীতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় স্বামী দাবি করেন, বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই স্ত্রী বাড়িতে অশান্তি শুরু করেছিলেন, কালক্রমে জমিও বিক্রি করেছেন। স্বামীকে না জানিয়ে স্ত্রীর জমি বিক্রির সিদ্ধান্তকেই নিম্ন আদালত স্বামীর প্রতি স্ত্রীর নিষ্ঠুরতা হিসেবে ধরে নেয়। এবং সেই যুক্তিতেই স্বামীর পক্ষে ডিভোর্সের নির্দেশ জারি করে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন স্ত্রী। সেই আপিল মামলাতেই বিচারপতি ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, জমি বিক্রির সিদ্ধান্তকে নিম্ন আদালত যে ভাবে স্ত্রীর নিষ্ঠুরতা বলে ধরেছে, তা অযৌক্তিক ও কষ্টকল্পনা।
এই মামলায় স্ত্রী লিখিত ভাবে নিম্ন আদালতে জানিয়েছিলেন, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পরেও তিনি তাঁর সঙ্গেই থাকতে চান। নিম্ন আদালতে মামলায় একটি ম্যারেজ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে তিনি দেখান, তাঁর স্বামী অন্য এক জনকে বিয়ে করেছিলেন। তা আটকাতে তিনি তাঁদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলার নথি থানায় জমা দেন। সেই নথি জমার পর নিম্ন আদালত দ্বিতীয় বিয়ের বৈধতা খারিজ করে। যদিও সে ক্ষেত্রেও ব্যারাকপুর আদালতের ব্যাখ্যা, যেহেতু দ্বিতীয় বিয়ে খারিজ হয়ে গিয়েছে তাই ওই মহিলার সঙ্গে সহবাস হয়নি। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের এই দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা করেছে।
সেই সঙ্গে অসুখী দাম্পত্যের যুক্তি উড়িয়ে ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, যে দম্পতি বিয়ের দু’বছরের মধ্যে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন, তাঁরা বিয়ের পর থেকে অসুখী–এটা বলা যায় না। স্ত্রী সংসারে থাকতে চান না–স্বামীর তরফে এই দাবিও ধোপে টেকেনি হাইকোর্টে। ডিভিশন বেঞ্চ মনে করিয়েছে, কামারহাটির একই বাড়িতে আলাদা ঘরে তাঁরা দু’জনই থাকেন। স্ত্রীর বিরুদ্ধে সম্পর্ক ছেদের অভিযোগ তোলা হলেও নথি প্রমাণ করছে, স্বামীই চান না স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করতে। শেষ পর্যন্ত নিম্ন আদালতের ২০১৪ সালে দেওয়া ডিভোর্সের রায় খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট।