কুবলয় বন্দ্যোপাধ্যায়
এমন চিৎকার যে, কান পাতা দায়। হুলক গিবনগুলোর চিৎকার। হুলক গিবন। এক ধরনের উল্লুক। হুলক গিবনদের খাঁচার সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওই চিৎকার শুনছিল ওরা। যা ওরা আগে কখনও শোনেনি। ৫৭ জন পড়ুয়ার সবার কান গিবনদের এনক্লোজ়ারের দিকে ঘোরানো। পড়ুয়াদের সঙ্গে আসা এক মহিলা বলছিলেন, ‘এরা হুলক গিবন। পুরুষদের রং কালো, তবে ওদের ভুরুগুলো ধবধবে সাদা।’

কয়েক মিনিট পর পড়ুয়াদের ওই দলটাই দাঁড়িয়েছিল ম্যাকাওদের এনক্লোজ়ারের সামনে। উজ্জ্বল সোনালি আর নীল রংয়ের গোল্ডেন ব্লু ম্যাকাও এবং সিঁদুরে লাল স্কারলেট ম্যাকাওয়ের দল বিশাল এনক্লোজ়ারের মধ্যে খালি উড়ে বেড়াচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যও থামছিল না ওদের ডাক। কেউ এক জন পড়ুয়াদের কাছে ওই পাখিদের অসামান্য রূপের বর্ণনা দিয়ে চলেছিল।

বর্ণনা দিতে হচ্ছিল। কারণ, জন্ম থেকেই ঘন অন্ধকার দেখে এসেছে ওই পড়ুয়ারা। পোশাকি ভাষায়, দৃষ্টিহীন। ‘সোনালি’, ‘নীল’, ‘সিঁদুরে লাল’ শব্দগুলোর অর্থ ওরা কতটা বুঝতে পারছিল কে জানে, কিন্তু ওরা সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন শুষে নিচ্ছিল ওই প্রতিটি শব্দ। পাখি এবং অন্য জন্তুদের বর্ণনা, ওদের ডাক সবটাই ওরা কান দিয়ে দেখছিল।

বুধবার সকালে ৫৭ জন দৃষ্টিহীন স্কুলপড়ুয়া চিড়িয়াখানা বেড়াতে এসেছিল। ওদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। কয়েক দশক ধরে দৃষ্টিহীনদের নিয়ে নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সিদাম সাহা। এ দিন মূলত তাঁরই উদ্যোগে ওই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্নরা জীবনে প্রথম বার চিড়িয়াখানা বেড়াতে এসেছিল। সিদাম সাহা বলছেন, ‘৭ ডিসেম্বর, ১৯০৫- এই তারিখটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই তারিখে পৃথিবীর প্রথম কর্নিয়া প্রতিস্থাপন হয়েছিল। তাই, আমি চেয়েছিলাম ওই দিনটায় বা তার আশপাশের কোনও তারিখে পড়ুয়াদের চিড়িয়াখানা নিয়ে আসার।’ নতুন জায়গায় যাওয়ার উত্তেজনা তো ছিলই। এর পাশাপাশি, চিড়িয়াখানায় এসে নানা ধরনের জন্তু ও পাখির ডাক শুনে আনন্দ আর ধরে না পঙ্কজ গুপ্তা, হংসিকা ঠাকুর, সরস্বতী মালি, রীতা সাহানি, সোমনাথ মালিক ও অন্যদের।

পঙ্কজ দক্ষ দাবাড়ু, সাদা-কালো খোপ ও ঘুঁটিই ওর জগৎ। যে কারণে মনঃসংযোগ ওর সহজাত। চিড়িয়াখানায় এসে তাই শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গোটা পারিপার্শ্বিক বুঝে নিতে পঙ্কজের তেমন অসুবিধে হয়নি। পঙ্কজ বলছে, ‘এত অদ্ভুত অদ্ভুত সব আওয়াজ আগে কখনও শুনিনি। এত জন্তু, এত পাখির নামও জানতাম না। সম্পূর্ণ অন্য এক জগতের সন্ধান পেলাম।’

ওদের মধ্যে ভালো আবৃত্তি করে সরস্বতী। চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে সে-ও কম মুগ্ধ নয়। সরস্বতী বলছে, ‘টিভি-তে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এমন জন্তু, পাখিদের ডাক আমি শুনেছি। কিন্তু এটা তো ওদের ডাক সরাসরি, একেবারে সামনে থেকে শোনা।’ রোমাঞ্চিত সরস্বতীর কথায়, ‘ভাবতেই পারছি না!’

এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন চিড়িয়াখানার অধিকর্তা শুভঙ্কর সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে, যত শিগ্‌গিরি সম্ভব বিভিন্ন এনক্লোজ়ারের সামনে জন্তুদের পরিচয় লেখা বোর্ডগুলোর পাশাপাশি ব্রেল পদ্ধতিতে লেখা বোর্ড বসানোর। যাতে দৃষ্টিহীন কোনও দর্শক এলে তিনি নিজেই কোনও জন্তু বা পাখি সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version