শীত-রাতে আলোর বন্যা নদিয়ার গ্রামে গ্রামে। আসলে চন্দ্রমল্লিকা ফোটাচ্ছেন ফুলচাষিরা। গ্রামের অলিগলিতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু বসতি এলাকা ছাড়িয়ে এগোলেই চোখে পড়ে এলইডি বাল্ব সারি দিয়ে ঝোলানো চন্দ্রমল্লিকার চাষজমিতে।
ফুলের বাজারে কোন তারিখে চাহিদা বেশি আগাম বুঝে আলো নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমতো দিনে চন্দ্রমল্লিকা ফোটাচ্ছেন রানাঘাট লাগোয়া পুরাতন চাপড়া, নোকাড়ি, পূর্ণনগর, মাটিকুমড়ো, রায়নগর, দৌলা, দত্তপুলিয়া, ধানতলা, দেবীপুরের ফুলচাষিরা। সে ফুল বর্ণে ও আকারে বেশ নজরকাড়া। গাছও বেশ লম্বা। সাত-আটটি গ্রামে ফুল চাষির সংখ্যা হাজার দুয়েক।
পুরাতন চাপড়ার এক ফুলচাষি নরেশ মণ্ডল বললেন, ‘শীতকালে বেলা ছোট হওয়ায় বেশির ভাগ দিনই সকাল ন’টা না বাজলে ভালো করে সূর্যের রোদ পড়ে না। আবার সাড়ে চারটে বাজলেই সূর্যের আলো কমে যায়। শীতের দিনে ঠিকঠাক আলো না পাওয়া চন্দ্রমল্লিকা গাছে আগে যে ফুল আসতো, তা খুব বেশি বড় হতো না। আর গাছ উচ্চতায় এক হাত লম্বা হতে না হতেই কুঁড়ি এসে যেত। ফুল ধরার আগেই সে গাছ নুইয়েও পড়ত। ছোট ছোট ফুল আসায় ভালো দাম পেতাম না। তাই জমিতে রাতে বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে চন্দ্রমল্লিকা গাছ উচ্চতায় আড়াই হাত পর্যন্ত লম্বা করছি এখন। এভাবে চাষ করে গাছে যে ফুল আসে, সেই ফুলের থাবা বেশ বড় হয়, বেশ নজরকাড়াও হয়। ভালো দামও মিলছে।’
গত সাত-আট বছর ধরে চলছে এই কৌশলে ফুলচাষ। লোকমুখে ছড়িয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামে। পুরোনো চাপড়ার এক ফুল চাষি লক্ষ্মণ মণ্ডল বললেন, ‘বুদ্ধিটা কোথা থেকে এসেছে, জানি না। আমি অন্যের দেখেই শিখেছি।’ বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যান পালন দপ্তরের অধ্যাপকদের কারও কারও কাছ থেকেও এমন পরামর্শ গ্রামের চাষিদের কাছে এসেছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
কৃষ্ণনগরের রাষ্ট্রীয় উদ্যান পালন ও গবেষণা কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত উদ্যানবিদ ব্যাসদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘দপ্তরে দায়িত্বে থাকার সময় ফুলচাষিদের আমরা এমনই পরামর্শ দিয়েছিলাম। প্রয়োজনীয় জল-সার ইত্যাদি তো চাষিরা দেনই। শীতের সময়ে তাড়াতাড়ি সূর্য ডুবে যায় বলে বিকল্প জোরালো আলোর ব্যবস্থা করে গাছের বৃদ্ধি করা বিজ্ঞানসম্মত। আলো পেয়ে গাছ উচ্চতায় বড় হয়ে যায়। হৃষ্টপুষ্টও হয়। কুঁড়ি বা ফুল তুলনায় বেশি দিন থাকে গাছে।’
ফুলচাষি নরেশ মণ্ডল বলেন, ‘চারা লাগানোর দিন সাতেক পরেই কৃত্রিম আলো দেওয়া শুরু করতে হয়। সাত-আট হাত অন্তর নয় বা দশ ওয়াটের একটি করে এলইডি বাল্ব সারি সারি করে জমিতে ঝোলাই আমরা।’ কেউ একটানা কুড়ি দিন, কেউ এক মাস, কেউ বা চল্লিশ দিন আলো জ্বালিয়ে রাখেন চন্দ্রমল্লিকার চাষ জমিতে। আলো বন্ধ করার দিন পনের বাদে কুঁড়ি আসে। তারপর ফুল ফুটতে আরও দু’তিন সপ্তাহ। যেমন, ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে ফুলের বড় বায়না থাকলে তার জন্য পৌষের শেষ দিকেই আলো বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
এক ফুল চাষি নকুল মণ্ডল বলেন, ‘বর্ষায় চন্দ্রমল্লিকা চাষে প্রতি বিঘায় প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ হয়। আর শীতে বিদ্যুতের বিল দেওয়ার পরেও খরচ থাকে ৫০ থেকে ৭৫ হাজারের মধ্যে। ভালো বাজার থাকলে শীত মরশুমে নজরকাড়া একটা একটা চন্দ্রমল্লিকা পাঁচ টাকা পর্যন্ত পাইকারি দাম মেলে।’ আরও এক ফুলচাষি বললেন, ‘গতবার ভালো দাম পাইনি। এবার বাজার ভালো। এক একটা ফুল পাঁচ টাকা তো বটেই, সাড়ে পাঁচ টাকা পাইকারি দামও পাচ্ছি।’ আলোর বন্যায় লক্ষ্মীলাভ হচ্ছে নদিয়ার গ্রামে গ্রামে।