অরূপকুমার পাল, ঝাড়গ্রাম

এক সময়ে লোধা-শবরদের ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ তকমা দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সেই দুর্নাম ঘোচেনি। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলি জীবনে দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী। সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন জঙ্গলমহলে কুষ্ঠরোগীদের সেবার কাজে আসা গেরুয়াধারী এক সন্ন্যাসী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার আর দেশি মদের জন্যেই ‘অপরাধ’ জগতে পা রাখেন লোধা-শবররা। দিনের বেলাতেও তাই লোধাশুলির জঙ্গলে লুটপাট-ডাকাতি লেগেই থাকে।

লোধা-শবরদের মূলস্রোতে ফেরাতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন সেই গেরুয়াধারী। রোজ সকালে বিনামূল্যে তিনি ২ কেজি করে চাল বিতরণ করতেন। শর্ত একটাই, তাঁর আশ্রমে সকালে এসে বলতে হবে, ‘আমি কাল রাতে চুরি করিনি।’ প্রথমে অবশ্য তাঁকে ‘পুলিশের চর’ ভেবে সন্দেহই করেন লোধা-শবররা। কিছু দিন যেতে সেই ভুল ভাঙে তাঁদের। তার পরে হঠাৎ এক দিন চাল বিলির সময়টা বদলে দিলেন সন্ন্যাসী।

সকালে নাম লেখালে বিকেল তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত চাল দেওয়া হবে। কারণ বিকেলে চাল পেলে অভুক্ত থাকা লোধা-শবররা সন্ধেবেলায় পেট ভর্তি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন এবং রাতে আর চুরি করতে যাবেন না। কাজ হলো এই কৌশলে। ওই এলাকায় বন্ধ হলো চুরি-ডাকাতি-লুটমার।

চাষজমিতে মজুরি, বাড়িতে ফাই-ফরমাশ খাটার কাজ পেতে শুরু করলেন আদিম জনজাতির মানুষগুলো। যা কিনা ধীরে ধীরে বদলে দিল তাঁদের জীবন। গল্পটা করছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা জিতেন শবর। তাঁর কথায়, ‘চুরির বদলে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন মহারাজ। যা কিনা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন বদলে দিয়েছিল। এখন আর লোধা-শবরদের কেউ চোর বলে না!’

সেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী স্বামী ভবানন্দ শতবর্ষে পৌঁছেও প্রাণচঞ্চল কর্মযোগী। বয়সটা তাঁর কাছে স্রেফ সংখ্যামাত্র। ঝাড়গ্রাম জেলার মানিকপাড়া সাকিন তাঁর। সেখানেই শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তাঁর একশো বছরের জন্মদিন পালনের জন্য গঠন করা হয়েছে ‘স্বামী ভবানন্দ জন্মশতবর্ষবার্ষিকী উদযাপন কমিটি’।

কমিটির আহ্বায়ক শম্পা ঘোষ বলেন, ‘মহারাজের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ২৭ জানুয়ারি তা শুরু হয়েছে। সেখানে মহারাজের নানা কর্মকাণ্ডকে চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মহারাজের জীবনকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করা হয়েছে।’

জন্ম ১৯২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি, পূর্ববঙ্গের মাদারিপুরে। বর্তমানে যা বাংলাদেশে। প্রথম জীবনে মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গী অমূল্যভূষণ দে-র হাত ধরে বিপ্লবে হাতেখড়ি। পরে ১৯৫৫ সালে বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নেন। ৬২-এর হিমালয় যাত্রা বদলে দেয় জীবন। কুষ্ঠ রোগীদের দেখে মনস্থির করলেন মোক্ষ নয়, সেবাই পথ। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগে যোগাযোগ করলেন।

কুষ্ঠরোগীদের সেবার কাজ শুরু হলো অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গিধনির চারচাকা গ্রামে(বর্তমানে যা ঝাড়গ্রাম জেলায়)। তারপর ১৯৬৯ সালে ঝাড়গ্রাম ব্লকের মানিকপাড়ায় আসা। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেন এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। এলাকাবাসীর খাদ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের কথা ভেবেছেন। এলাকায় কারখানা খোলার জন্য যোগাযোগ করেছেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। এমনকী, পেপার মিল তৈরির ক্ষেত্রে শর্ত রেখেছেন, বাইরে থেকে শ্রমিক আনা যাবে না। স্থানীয়দের কাজ দিতে হবে। ফলে পেপার মিলে কাজ পান বহু মানুষ।

কাঁসাই নদীর তীরে চাষজমি বাঁচাতে সরকারি সাহায্য ছাড়াই আড়াই কিলোমিটার বাঁধ তৈরি করেছিলেন। টেকনিক্যাল সাপোর্ট হিসেবে তিনি পাশে পেয়েছিলেন খড়গপুর আইআইটির কয়েকজন অধ্যাপককে। একসময়ে ঝাড়গ্রামের রাজা নরসিংহ মল্লদেব, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজিত পাঁজা, খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তন ডিরেক্টর সিআর সেনগুপ্ত প্রমুখের আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন নিয়মিত।

কুষ্ঠরোগীদের জন্য গিধনি, মানিকপাড়া, খড়্গপুর, নিমপুরা, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকায় সেবাকাজ চালিয়েছেন সন্ন্যাসী। মানিকপাড়ায় কুষ্ঠ হাসপাতাল তৈরি করেছেন। এক সময়ে কুষ্ঠরোগীদের জন্য রেশনেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের জমিতে তৈরি হয় রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম বাজার।

বাজারের সম্পাদক জগন্নাথ মল্লিক বলেন, ‘মহারাজের দেওয়া জমিতেই এই বাজার। এখানে ১৫০টি দোকান রয়েছে। এছাড়াও প্রচুর চাষি এখানে সব্জি বিক্রি করেন। মানিকপাড়া এলাকার মানুষের জীবনে মহারাজের প্রভাব অনস্বীকার্য।’ শতবর্ষে পৌঁছেও সেই মানুষটির উদ্যম কমেনি এতটুকু। মানিকপাড়ার নির্মাণ তাঁর হাতে, এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন স্থানীয়রা। তাই তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে মেতে উঠেছে গোটা মানিকপাড়া!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version