দু’টো গানের একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, আর একটা বাংলা আধুনিক গান। আধুনিকের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। রবিগানে বলা হচ্ছে, ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া বিখ্যাত গানটার কথা হলো, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে…।’ তবে স্যরি গুরুদেব, স্যরি গৌরীপ্রসন্নবাবু, কিছু মনে করবেন না।
এই আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের প্রজন্ম, জেন জ়ি-র সোজাসাপটা দর্শন হলো যে, প্রেম আসে না, বরং প্রেমকে আনতে হয়— প্রেম যাতে আসে, সে রকম পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়। আবার এই পরিস্থিতি তৈরি মানে গালে আফটার শেভ লোশন মাখা, ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া, নিজেকে স্ট্রিটস্মার্ট করে তোলা নয়। পরিস্থিতিটা তৈরি হচ্ছে নেট দুনিয়ায়।
সোজা কথাটা সহজ ভাবে বলে দেওয়া যাক। জেন জি় ক্রমে বদলে ফেলছে তাঁদের ডেটিং ডেস্টিনেশন। এমনিতে ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের মতো সিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপার থেকে তো তাঁরা দূরে ছিলই। আর এখন সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীকে বেছে নিতে তাঁদের পছন্দের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে লিঙ্কডইন। কম্পোজ় করার ভুল নয়, ঠিকই পড়েছেন। লিঙ্কডইন-ই। যা ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কারবার এবং চাকরি বা নিয়োগ কেন্দ্রিক সব চেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বলে পরিচিত।
অথচ সেটাই এখন জেন জি়-র কাছে জীবনসঙ্গী বা তাৎক্ষণিকের সঙ্গীর খোঁজ করার সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা। গুগলের তথ্য বলছে, ২০২১ থেকে এখনও পর্যন্ত সেখানে ‘ডেট করার জন্য কী ভাবে সঙ্গী খুঁজব’ লিখে সার্চ করা বেড়েছে প্রায় ২০০ শতাংশ। একটি ডেটিং সাইটের তথ্য জানাচ্ছে, ২০ থেকে ৪০ বছরের মানুষদের ৫০ শতাংশের বেশি লিঙ্কডইনকে কখনও না-কখনও ডেটিং সাইটের মতো করে ব্যবহার করেছেন। আর শুধু জেন জি়-র কথা ধরলে, সেটা ৫২ শতাংশ!
অর্থাৎ, জেন জ়ি-র কাছে প্রেম আসার পরিস্থিতি তৈরির জায়গা হলো লিঙ্কডইন।
কিন্তু কেন এই ট্রেন্ড?
তথ্য হিসেবে যেটা উঠে আসছে, তা হলো: লিঙ্কডইনে এক জন মানুষের প্রোফাইলের বিশ্বাসযোগ্যতা খানিকটা বেশি। এক ছাতার তলায় সেই মানুষটির পড়াশোনা, পেশার খতিয়ান থেকে কেরিয়ারের চাহিদা, এ সবের একটা আন্দাজ পাওয়া যায় সহজেই। তাই, পছন্দ বা অপছন্দ বুঝে নেওয়ার একটা ফিল্টার এমনিতেই থাকছে। জেন জি়র এক জনের কথায়, ‘ডেটিং অ্যাপে আসা কারও মেসেজ ফেক হতে পারে, লিঙ্কডইনে তেমনটা হওয়ার ভয় নেই।’
কলকাতার জেন জি়-দের মধ্যে চেনামুখ, অভিনেত্রী অনুষা বিশ্বনাথন বলছেন, ‘ব্যক্তিগত ভাবে আমি ডেটিং অ্যাপ কখনও ব্যবহার করিনি। আমি এখনও এই ধারণাতেই বিশ্বাস রাখি যে, প্রেম হয়ে যায়।’ অনুষার ব্যাখ্যা, ‘লিঙ্কডইনের মাধ্যমে ডেটিংয়ের সঙ্গী বা সঙ্গিনী খোঁজার টেন্ডে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, পেশা বা কর্মক্ষেত্র দেখে ডেটিংয়ের পার্টনার বেছে নেওয়ার সুযোগ এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে।
আমাদের বর্তমান জীবন ও যাপনের সঙ্গে কেরিয়ারের সম্পর্ক অত্যন্ত ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। হয়তো সে জন্যই ডেট করার ক্ষেত্রে এ দিকটায় অনেকে বেশি করে খেয়াল রাখতে চাইছেন।’ জেন জ়ির অনেকেরই বক্তব্য, ডেটিং অ্যাপ থেকে সিরিয়াস সম্পর্ক তৈরির পার্টনার পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাঁদের অনেকের মতে, ডেটিং অ্যাপে বা ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে বিয়ের পিঁড়িতে বসার একটা তাড়াহুড়ো থাকে অনেক সময়ে। তবে লিঙ্কডইনে কাউকে পছন্দ হলেও অমন চাহিদা এড়ানো সম্ভব বলে তাঁরা মনে করছেন।
জেন জি়-র একটা বড় অংশের মনে হচ্ছে, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে কথাবার্তা শুরুর পর সেটিকে ‘ডেট’ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ঝক্কির। আসলে জেন জ়ি-র অনেককে গ্রাস করেছে ‘ডেটিং ফ্যাটিগ’। তাঁরা চান সূক্ষ্ম রুচিসম্মত পার্টনার এবং সে ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে লিঙ্কডইন-ই আদর্শ।
তবে লিঙ্কডইনের কমিউনিটি গাইডলাইনে পেশাগত ক্ষেত্র বাদে অন্য ভাবে অ্যাপটিকে ব্যবহার না-করতে বলা হয়েছে। কাজেই, কাজ-কারবারের আস্তানা লিঙ্কডইনকে প্রেমের ধাম হিসেবে পুরোদস্তুর ব্যবহার করা মুশকিল। সমস্যা অন্য জায়গাতেও। লিঙ্কডইনে থাকা মহিলাদের ৪৩ শতাংশ জানিয়েছেন, সামনের ব্যক্তি কাজের সীমারেখা টপকে ফ্লার্ট করায় অস্বস্তিতে পড়েছেন তাঁরা।
অ্যাপ যেমনই হোক, ডেট খোঁজার ইউএসপি ঠিক কী? জেন জি়-র উত্তর, বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব তৈরি না-হলে প্রেমের সম্পর্ক এগোবে কী ভাবে?
সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ-কারবারের প্ল্যাটফর্ম লিঙ্কডইনকে জেন জ়ি-র অনেকে ব্যবহার করছে পার্টনার খোঁজার জন্য। কিন্তু লিঙ্কডইন কি সেই মতো করে নিজেকে বদলাবে?
প্রেম কিন্তু নিজেকে বদলে ফেলেছে এআই-শাসিত এই যুগে। সে আর নিঃশব্দে, নীরবে আসছে না। প্রেম কিন্তু নিজেকে বদলে ফেলেছে এআই-শাসিত যুগে। সে আর নিঃশব্দে, নীরবে আসছে না।