কুবলয় বন্দ্যোপাধ্যায়

ইগনিশনে চাবিটা ঘোরাতেই আদুরে গর্জন করে উঠল ফ্রাঙ্কফুর্টের কারখানায় তৈরি ইঞ্জিন। গিয়ারে ফেলে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিতেই গড়াল চাকা। কে বলবে, গাড়িটার বয়স ৮৬ বছর! তার চেয়েও বড় কথা, কে বলবে ওই গাড়ি ২২ বছর ধরে পুরোপুরি মাটিচাপা অবস্থায় ছিল? হ্যাঁ, মাটিচাপা-ই। কিন্তু কেন মাটিচাপা?

কারণ, ‘ওই গাড়িটাই চাই’, জেদ ধরেছিলেন লেডি মেরি স্ট্রেঞ্জওয়েজ়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেল স্যর জন আর্থার হার্বার্টের স্ত্রী তিনি। সালটা ১৯৪৩। স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে। এমন পরিস্থিতিতে এক ‘নেটিভ’ কি না জার্মান অ্যাডলার ট্রায়াম্ফ জুনিয়র গাড়ি চেপে ঘুরবে! গাড়ির মালিক যে এক বাঙালি! বরাহনগরে তাঁর বাগানবাড়ি।

তবু গভর্নর জেনারেল স্বামীর কাছে ‘ওই গাড়িটারই’ বায়না জুড়েছিলেন লেডি। তবে গাড়ির মালিক বিক্রি করতে রাজি না-হলে? তা হলে আবার কী? কেড়ে আনা হবে। খবর গিয়েছিল গাড়ির ওই ‘নেটিভ’ মালিকের কাছেও। গাড়ি বাঁচানোর জেদ চেপে গিয়েছিল তাঁর। মাটিতে পুঁতে দেবেন, তবু সাধের গাড়ি গভর্নরের হাতে যেতে দেবেন না।

রাতারাতি ওই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বরাহনগরে নিজের বাগানবাড়িতে। নির্দেশ ছিল মাটিতে পুঁতে দেওয়ার। গাড়ি জবরদখল করে তাতে আর চড়া হয়ে ওঠেনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফার্স্ট লেডির। ১৯৩৮ সালে তৈরি ১০ হর্সপাওয়ার ইঞ্জিনের ওই অ্যাডলার ট্রায়াম্ফ জুনিয়ার গাড়ি ফের কলকাতার রাজপথে বহু মানুষের অবাক করা নজর মাখল সর্বাঙ্গে। রবিবার।

অটোমোবাইল অ্যাসেসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার (এএইআই) উদ্যোগে এ দিন আয়োজিত ভিন্টেজ কার র‍্যালিতে ঐতিহাসিক ওই গাড়ি-সহ অংশ নিয়েছিল ৬৫টি চারচাকার গাড়ি এবং ২০টি টু-হুইলার। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের সামনে শুরু হয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে প্রাচীন গাড়ির র‍্যালি এগোয়।

এমন ৮৫টি ‘বৃদ্ধ’ গাড়ির দলে পিতামহ ভীষ্মের মতো উপস্থিত ছিল ১৯১৩ সালে তৈরি একটি স্টোয়ার ওপেন ট্যুরারও। এএইআইয়ের অনারারি সেক্রেটারি এবং এ দিনের র‍্যালির অন্যতম উদ্যোক্তা প্রবীর রায় বলছিলেন, ‘যাঁরা পুরোনো গাড়ি ভালোবাসেন, তাঁদের আকর্ষণ করার মতো এই র‍্যালিতে অনেক কিছু রয়েছে। একশো বছর পার করা স্টোয়ার ওপেন ট্যুরার ছাড়াও একটা প্যান্থার স্লোপার মোটরবাইকও।

এই দু’টি গাড়িই অত্যন্ত বিরল। ১৯১৩-র তৈরি স্টোয়ার গোটা পৃথিবীতে ৮-১০টার বেশি চালু অবস্থায় নেই।’ গাড়ির দুনিয়ায় জাগুয়ার যেমন ‘কোভেন্ট্রি ক্যাট’ নামে পরিচিত, ঠিক তেমনই ইংল্যান্ডের ক্লেকহিটনে তৈরি প্যান্থার স্লোপার মোটর বাইক একটা সময়ে পরিচিত ছিল ‘দ্য ক্যাট ফ্রম ক্লেকহিটন’ নামে। এই মডেলের গাড়ি বেশ বিরল।

কার র‍্যালিতে দেখা গিয়েছে ১৯৩৫ সালের একটি ফোর্ড গাড়িকেও। এই গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছিল মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত ‘শুধু একটি বছর’ এবং ‘রাজকুমারী’ ছবিতে। র‍্যালিতে এসেছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ব্যবহার করা ১৯৪৮-এর প্লাইমাউথ গাড়িটিও।

Kolkata Municipal Corporation: লাল সিগন্যালে বন্ধ থাকুক ইঞ্জিন, প্রচারে পুর দপ্তর
তবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেলের হাত থেকে বাঁচাতে মাটি চাপা দেওয়ার মতো চমকপ্রদ ইতিহাস মনে হয় কোনও গাড়িরই নয়। ১৯৩৮ সালের ওই অ্যাডলার গাড়ির বর্তমান মালিক, কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্তা, ফার্ন রোডের গদাইচাঁদ দে বলছেন, ‘১৯৬৫ সালে ১২ ক্লাস পাশ করার পর বাবা আমাকে ওই গাড়ির চাবিটা দেন। আমাদের বরাহনগরের বাড়িতে গিয়ে আমি পুরনো এক মালির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, গাড়িটা মাটিতে পুঁতে তার উপরে একটা চাঁপা গাছ বসিয়ে দেন আমার ঠাকুরদা। সেই গাড়ি বার করে পুরো মাটি সাফ করানো হয়।’

২০ বছরের বেশি সময় ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ থাকার পরেও ৮৬ বছরের জার্মান গাড়ি ফের চোখ টানল সবার। যেমন, ৮১ বছর আগে, ১৯৪৩-এ টেনেছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফার্স্ট লেডি মেরি ফক্স স্ট্রেঞ্জওয়েজ়ের।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version