এই সময়, আসানসোল: দিনপনেরো আগের কথা। বেলঘরিয়ায় বিটি রোডের উপরে দিনেদুপুরে ব্যবসায়ীর গাড়িতে পরপর গুলি! অপারেশন চালিয়েই দ্রুতগতিতে গায়েব বাইকে করে আসা দুষ্কৃতীরা। অতঃপর বেলঘরিয়া থানায় যখন সেই ব্যবসায়ী বসে, তখনই তাঁর ফোনে আসে হুমকি- ‘বচ গয়া শালা!’ এই ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যার নাম উঠে আসে, বিহারের সেই কুখ্যাত গ্যাংস্টার সুবোধ সিংকে অবশেষে নিজেদের হাতে পেল এ রাজ্যের সিআইডি।রানিগঞ্জ, আসানসোল, শক্তিগড়, ডোমজুড়, বেলঘরিয়া, ব্যারাকপুর, রানাঘাট… অর্থাৎ বর্ধমান থেকে হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া। আর বাংলার বাইরে ওডিশা, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড। পাটনার জেলের কোনও এক ছোট্ট কুঠুরিতে বসে এ ভাবেই বিস্তৃত হয়েছিল ‘সুবোধ সাম্রাজ্য’!

মানিয়া সুরভে, রবি পূজারি থেকে শুরু করে দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা রাজন বা আবু সালেম- এ দেশে বাঘা বাঘা গ্যাংস্টারের তালিকা খুব ছোট নয়। তাদের কীর্তিকলাপ এমনই নাটকীয় যে বলিউডও একের পর এক হিট ছবির মশলা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সুবোধ সিংয়ের মতো এলাকা বিস্তার! হালফিলে এমন নজির পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের ধুরন্ধর অফিসারেরাও মনে করতে পারছেন না।

কেমন গ্যাংস্টার সুবোধ?
একটি ছোট্ট তথ্যেই বোঝা যায়- স্রেফ সোনা লুট করেই ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঘরে তুলেছে সে! এহেন সুবোধ ওরফে দিলীপ সিং-কে পাটনার বেউর জেল থেকে ট্রানজ়িট রিমান্ডে আসানসোলে এনেছে সিআইডি। রবিবার রাখা হয়েছে একদিনের জেল হেফাজতে। আজ, সোমবার ফের তোলা হবে আদালতে।

রবিবার আদালতে হাজিরার পরে বেরনোর সময়ে সাংবাদিকদের ভিড় দেখে সুবোধের দাবি, ‘আমি ছ’বছর ধরে জেলবন্দি। অযথা আমার নাম জড়ানো হচ্ছে। বাংলার পুলিশ অপরাধ ঠেকাতে পারছে না। তাই আমাকে ফাঁসাচ্ছে।’

কীসে ফাঁসানোর অভিযোগ এনেছে সুবোধ?
আপাতত সিআইডি-র হাতে ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রানিগঞ্জ থানার রামবাগান ডক্টর্স কলোনির বাসিন্দা, স্বর্ণব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি সুন্দর ভালোটিয়ার বাড়ির ডাকাতির মামলা রয়েছে। তবে হালফিলে বাংলায় সাড়া ফেলে দেওয়া রানিগঞ্জে সোনার দোকানে ডাকাতি এবং বেলঘরিয়ায় ব্যস্ত বিটি রোডের উপরে দিনেদুপুরে ব্যবসায়ীর গাড়িতে গুলিচালনার ঘটনাতেও জড়িয়েছে সুবোধের নাম।

এর বাইরে বাংলা এবং দেশের নানা প্রান্তে একাধিক ডাকাতি, তোলাবাজি, অপহরণের মাস্টারমাইন্ড যে এই কুখ্যাত গ্যাংস্টারই, তা-ও জেনেছেন তদন্তকারীরা। ফলে আসানসোল কোর্টে মামলা যত এগোবে, চার্জের তালিকাও সমানুপাতিক হারে দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০২২-এর ৪ মার্চ রানিগঞ্জে ডাকাতির তদন্তভার হাতে নেয় সিআইডি। তারা জানতে পারে, সুন্দর ভালোটিয়ার বাড়িতে ১০০ কেজির উপরে সোনা রয়েছে বলে খবর পেয়েছিল দুষ্কৃতীরা। রীতিমতো সশস্ত্র হয়ে সবরকম আটঘাট বেঁধে ভালোটিয়াদের বাড়িতে হামলা চালালেও বাড়ির এক মহিলার দুঃসাহসিক একটি ফোনে ডাকাতদের প্ল্যান ভেস্তে যায়। ডাকাতদের চোখ এড়িয়ে তিনি এক প্রতিবেশীকে ফোন করেন, তাঁর থেকে ফোন পেয়ে পুলিশ আসে, শুরু হয় গুলির লড়াই।

এতে দুই পুলিশ গুলিবিদ্ধ হলেও তিন জন ডাকাতকে পাকড়াও করা যায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই নাম আসে সুবোধের। তদন্তকারীরা জানতে পারেন আরও দু’টি তথ্য- এক, শুধু ডাকাতি নয়, ওই ব্যবসায়ীর পরিবারের কাউকে না কাউকে অপহরণেরও ছক ছিল ডাকাতদের। আর দুই, জেলে বসেই গোটা অপারেশনের রিমোট কন্ট্রোল নিজের হাতে রেখেছিল সুবোধ।

এরপরেই তাকে বাগে পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে সিআইডি। কিন্তু আইনি জটিলতায় বিহারের নালন্দা জেলার চিন্তিপুর গ্রামের এই বাসিন্দার নাগাল পাচ্ছিল না তারা। গত ৬ জুন পাটনার বেউর জেলে গিয়ে বন্দি সুবোধ সিং-কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। কিন্তু এরপরেই উপর্যুপরি দু’টি ঘটনায় সুবোধ আরও বেশি করে চলে আসে এ রাজ্যের পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের আতসকাচের নীচে।

গত ১৫ জুন বেলঘরিয়ায় বিটি রোডের উপরে দিনের আলোয় সকলের সামনে বাইকে করে এসে ব্যবসায়ী অজয় মণ্ডলের গাড়িতে গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। গাড়িতে বুলেটপ্রুফ কাচ থাকায় প্রাণে বেঁচে যান অজয়। সেখানেই শেষ নয়। অজয় যখন বেলঘরিয়া থানায় পুলিশের সামনে বসে, তখনই ফোনে আসে হাড় হিম করা শাসানি- ‘বচ গয়া শালা!’ এই হুমকি ফোন এসেছিল সুবোধের নাম করেই। তোলা চেয়ে একই রকম হুমকি ফোন যায় ব্যারাকপুরের আর এক ব্যবসায়ী তাপস ভগতের কাছেও।

ব্যারাকপুর কমিশনারেটের বিশেষ টিম বিহারে গিয়ে তিন জনকে গ্রেপ্তার করে আনে। এখন সুবোধকেও সিআইডি এ রাজ্যে নিয়ে আসায় ব্যারাকপুর কমিশনারেটের তদন্তকারীদের বক্তব্য, তাঁদের হাতে ধৃত তিন জনের সঙ্গে সুবোধের লিঙ্ক পাওয়া এবার সহজ হতে পারে।

বেলঘরিয়ার ঘটনার আগে ৯ জুন শিরোনামে আসে রানিগঞ্জে সোনার দোকানে ডাকাতি। সেদিন শ্রীপুর ফাঁড়ির ওসি মেঘনাদ মণ্ডলের একার বাধার সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ডাকাতরা। সে যাত্রায় তারা পালিয়ে গেলেও গুলিবিদ্ধ হয় তাদের পান্ডা সোনু সিং। পরে ঝাড়খণ্ড থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ক্ষেত্রেও উঠে আসে সুবোধের নাম। জানা যায়, ডাকাতরা সকলেই সুবোধের গ্যাং-মেম্বার।

এ ছাড়া ডোমজুড়, রানাঘাটে সোনার দোকানে ডাকাতিও সুবোধের গ্যাং-এর কাজ বলে তদন্তে উঠে আসে। রানাঘাটে সোনার দোকানে ডাকাতিতে (এ-ও সুবোধের কীর্তি বলে জানা যায়) ধৃত কুন্দন সিং ওরফে ফাইটারের (সুবোধের অন্যতম গ্যাং-মেম্বার) সঙ্গে আবার জুড়ে যায় ২০২৩ সালের ১ এপ্রিল শক্তিগড়ে ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে কয়লামাফিয়া রাজু ঝা খুনের ঘটনা।

জানা যায়, রাজু খুন হয়েছিল এই ফাইটারের হাতেই! ডোমজুড়ের ঘটনায় ধৃত রবীন্দ্র সাহানির সঙ্গেও সুবোধের লিঙ্ক মিলেছে। এ ছাড়া ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর ভরসন্ধেয় টিটাগড় থানার অদূরে শ্যুটআউটে স্থানীয় বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লার খুনের সুপারিও সুবোধের লোকেরাই নিয়েছিল বলে জেনেছেন তদন্তকারীরা। এর বাইরে ওডিশা, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ বা উত্তরাখণ্ডে একাধিক অপহরণ (বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের) এবং তোলাবাজি ছিল সুবোধের রুটিন কাজ। আর এই সুবিশাল কর্মকাণ্ড চালিত হতো পাটনার বেউর জেল থেকে।

‘জুয়েল থিফ’ সুবোধকে আদালতে পেশ, হেফাজতে নিয়ে জেলবন্দি গ্যাংস্টারের নেটওয়ার্ক জানতে চায় CID

সুবোধকে নাগালে পেতে সিআইডির স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ দিনদুয়েক আগে বিহারে যায়। সেখানকার আদালতে আবেদন করার পরে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হেফাজতে পাওয়া নিয়ে আইনি টানাপড়েন চলে। শেষমেশ বিহার পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের সাহায্যে শনিবার পাটনা আদালত থেকে ট্রানজ়িট রিমান্ড পায় সিআইডি।

শনিবারই সুবোধকে নিয়ে রওনা দেন অফিসারেরা। রবিবার সকালে আসানসোল জেলা হাসপাতালে মেডিক্যাল টেস্টের পরে বেলা পৌনে বারোটা নাগাদ তোলা হয় আদালতে। সিআইডি ১৪ দিনের হেফাজত চাইলেও রবিবার হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত বিচারক সুবোধকে একদিনের জন্য জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আজ তাকে ফের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের এজলাসে তোলা হবে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version