এই সময়, বর্ধমান: একটা অভিযানে যাবতীয় বিশ্বাস ভেঙে খানখান। জাতীয় সড়ক ধরে বর্ধমানে যাতায়াতের পথে যাঁরা শক্তিগড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাংলার ব্র্যান্ড মিষ্টি ল্যাংচা কিনতেন, শনিবারের পর তাঁরাই ঘেন্নায় মুখ বেঁকাচ্ছেন। এর পর ল্যাংচা কেনার আগে দশবার ভাবতে হবে বলে জানিয়েছেন বহু ক্রেতা। সোশাল মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে পচা ল্যাংচার কাহিনি।স্বাস্থ্য দপ্তর, পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ, ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর, মেট্রোলজি বিভাগের যৌথ অভিযানে যখন অন্তত তিনশো কেজি ছাতাধরা, আধভাজা, দুর্গন্ধ বের হওয়া জমিয়ে রাখা ল্যাংচা বাজেয়াপ্ত করা হয় তখন অনেকেই তা বিশ্বাস করতে পারেননি। এর পর জেসিবি এনে গর্ত খুঁড়ে শক্তিগড়ের বিভিন্ন দোকান থেকে বাজেয়াপ্ত সেই পচা ল্যাংচা যখন পুঁতে দেওয়া হলো তখন মিষ্টিরসিকদের বিশ্বাস টোল খায়। তাহলে কি যাতায়াতের পথে এমনই ল্যাংচা কেনেন তাঁরা? নিয়ে আসেন বাড়ির জন্য? প্লেট সাজিয়ে দেন অতিথিদের?

রবিবার তারপীঠ থেকে কলকাতা ফিরছিলেন পর্যটক অতনু ভট্টাচার্য। বলেন, ‘আমি মাসে দু’বার তারাপীঠ যাই। প্রতিবার ফেরার পথে একশো-দেড়শো পিস ল্যাংচা নিয়ে যাই আত্মীয় পরিজনের জন্য। সেগুলোর গুণগত মান নিয়েই তো এখন প্রশ্ন জাগছে। আমাদের বিশ্বাসের গলা টিপে খুন করেছে ব্যবসায়ীরা। আজও এখানে দাঁড়িয়েছি, তবে শুধু চা খেয়ে চলে যাচ্ছি। টাকা দিয়ে বিষ কিনতে যাব কেন?’

২০২০ সালে ল্যাংচার জিআই ট্যাগের জন্য উদ্যোগ নেয় রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ। এর আগে বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা ও গোবিন্দভোগ চাল জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। ল্যাংচার জিআই স্বীকৃতি মিললে এই মিষ্টির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু, ল্যাংচা কেলেঙ্কারি পুরো প্রক্রিয়ায় জল ঢেলে দিল বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে ব্যবসায়ীদেরই একটি গোষ্ঠী।

কার্যত ফাঙ্গাস ধরা পচা ল্যাংচার ঘটনায় আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন শক্তিগড়ের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিনের মিষ্টি ব্যবসায়ী বিদ্যুৎ ঘোষ বলেন, ‘সততার সঙ্গে ব্যবসা করে এসেছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। আমরাও সেই পথে চলেছি। কিন্তু, অল্পদিনে বেশি লাভ করতে চাওয়া কিছু ভুঁইফোড়ের জন্য আমাদের এই অবস্থা।’

জানা যাচ্ছে, মূলত ২১ জুলাইয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে তৈরি করে রাখা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ ল্যাংচা। এই দিন ধর্মতলায় তৃণমূলের শহিদসভায় ভিড় হয় কয়েক লক্ষ মানুষের। তাদের অনেকেই যাতায়াত করেন জাতীয় সড়ক ধরে। শক্তিগড়ের দোকানগুলোয় ল্যাংচা কেনার ভিড়ও হয়। তখন আর গুণাগুণ বিচারের সময়, সুযোগ কোনওটাই থাকে না ক্রেতাদের। আর সেই সুযোগই কাজে লাগিয়ে বাসি, পচা ল্যাংচা বিক্রি করার মতলব এঁটেছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু মিষ্টি ব্যবসায়ী।

শনিবারের অভিযানের পর রবিবার তার প্রভাবও পড়েছে। বিদ্যুৎ বলেন, ‘আজ ভিড় থাকলেও ল্যাংচার ক্রেতা প্রায় নেই বললেই চলে। মিষ্টি কিনলেও ল্যাংচা কিনছেন না কেউ। এটা আমাদের কাছে দুর্ভাগ্যের।’ ব্যবসায়ী জাভেদ ইসলাম বলেন, ‘একবার বিশ্বাস হারালে সেটা ফিরে পেতে জীবন চলে যায়। আমাদের তিন পুরুষের দোকান। লোকে চোখ বন্ধ করে আমাদের থেকে কেনেন। আমরা কোয়ালিটি মেনটেন করি বলে আজও মানুষের ভালোবাসা পাই। কিন্তু এবার কয়েকজন ব্যবসায়ীর জন্য আমাদেরও ভুগতে হবে। এখানকার ল্যাংচা ব্যবসায়ীদের কাছে বিষয়টা ভালো বিজ্ঞাপন নয়।’

ল্যাংচায় গড়বড়! শক্তিগড় পরিদর্শনে গিয়ে একাধিক দোকানে নোটিশ

যে ল্যাংচার এত সুনাম তা কেন এভাবে বিক্রি হচ্ছে? কেন এই লোক ঠকানো কারবার? কেন মানুষকে অসুস্থতার পথে ঠেলে দেওয়া? অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া ডেপুটি সিএমওএইচ সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ‘আমরা এর আগেও অভিযান চালিয়েছি। সেদিনও সতর্ক করেছিলাম আমরা। কিন্তু অবস্থার কোনও বদল ঘটেনি। এই অভিযান আমাদের চলবে, তবে অতর্কিতে। জেলার আরও কিছু জায়গায় আমরা অভিযানে নামব।’

জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘চারটি দোকানের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সেই দোকানগুলোয় পুলিশ নোটিস দিয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যাতে হয় তার ব্যবস্থা করা হবে।’ কিন্তু, প্রশাসনিক পদক্ষেপে কি আর ফিরবে গুডউইল? রসিকমহলের প্রশ্ন এখন এটাই।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version