তিনি পরোপকারী ও মিশুকে ঠিকই। কিন্তু হাসপাতালে তাঁর পরিচয় একজন ধূর্ত ও ক্ষমতালোভী এবং দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। শান্ত স্বভাবের সেই একই লোক আবার নিজের এলাকায় প্রায় সর্বজনশ্রদ্ধেয়। স্থানীয়দের কাছে তাঁর পরিচয় গরিবের ডাক্তারবাবু হিসেবে।তিনি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর দেবাশিস সোম। কর্মক্ষেত্র ও পাড়ায় ভাবমূর্তির এমন বৈষম্য চট করে দেখা যায় না। দুর্নীতির অভিযোগে ধৃত আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতার কারণেই তিনি সিবিআই স্ক্যানারে রয়েছেন। তাঁর বাড়িতে সিবিআই হানা দেওয়ার খবরে হতবাক গোটা কেষ্টপুর। সুলভে রোগী দেখার জন্য চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় দেবাশিসের নামডাকই সবচেয়ে বেশি বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।

অথচ আরজি করের চিকিৎসকরা বলছেন ঠিক উল্টো কথা। এমনিতে মিতভাষী দেবাশিসকে তাঁরা সন্দেহাতীত ভাবে সন্দীপের যাবতীয় দুর্নীতির নেপথ্যে থাকা অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘দেবাশিস সোমকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জোরে নয়, অভিজ্ঞতার জন্যই ফরেন্সিক মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উনি ডেমনস্ট্রেটর। অথচ ওকে বিভাগে দেখা যেত না। বরং অধ্যক্ষের ঘরের পাশে ওঁর জন্য প্রায় সমমানের একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছিল। সেখানেই বসতেন।’

এ দিকে নিজের পাড়া দেবাশিসের পড়শিরা বলছেন, বিপদের সময়ে এবং রাত-বিরেতে বাড়িতে পৌঁছে রোগী দেখায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
গত ২৫ অগস্ট বাড়িতে সিবিআই হানা দেওয়া এবং তার পরেই কেন্দ্রীয় সংস্থার তাঁকে তলব করার সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় আচমকাই ষাটোর্ধ্ব দেবাশিস গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে অ্যাপোলোয় ভর্তি করা হয় তাঁকে। দীর্ঘ দিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিস রোগী দেবাশিসের কিডনি, অন্ত্র এবং ফুসফুসে বড়সড় সমস্যা ধরা পড়ে। ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়।

গত শুক্রবার ছুটি দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে। রবিবার ও সোমবার বাজারে চাউর হয়ে যায়, হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই সোজা প্রবাসী ছেলের কাছে ইউরোপে চলে গিয়েছেন দেবাশিস। বুধবার তাঁর কেষ্টপুরের বাড়িতে গিয়ে অবশ্য দেখা গেল, তিনি এখানেই রয়েছেন। তবে অসুস্থ, অশক্ত। এমনটাই দাবি তাঁর স্ত্রীর।

কেষ্টপুর ঘোষপাড়ার ১৬ ফুট বলে পরিচিত এলাকায় এজি ব্লকে দেবাশিসের মাঝারি মাপের দোতলা বাড়ি। একতলায় গ্যারাজ ও চেম্বার। দোতলায় থাকেন স্বামী-স্ত্রী। বারান্দা থেকে নিজেকে ‘মিসেস সোম’ পরিচয় দিয়ে এক প্রৌঢ়া বলেন, ‘উনি (দেবাশিস) খুব অসুস্থ। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। ওঁকে ছেড়ে দিন, বিশ্রাম নিচ্ছেন, নিতে দিন। এই ক’দিন আগেই তো ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়েছেন।’ বার বার অনুরোধেও কাজ হয়নি। দরজা খোলা হয়নি বাড়ির ভিতর থেকে। প্রৌঢ়ার দাবি, বাইরে কোথাও যাননি দেবাশিস।

প্রতিবেশীরাও একই কথা বলছেন। তাঁদেরই অন্যতম, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী মৃগাঙ্ক খাঁ বলছেন, ‘গত তিন দশক ধরে দেবাশিসবাবু আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ছিলেন। ওঁর মতো মানুষ হয় না। আগে ১০ টাকায় রোগী দেখতেন। উনি আরজি করের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, বিশ্বাসই হচ্ছে না।’ তিনি জানান, দেবাশিসের ছেলে বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষার পরে জার্মানিতে থাকেন এখন কর্মসূত্রে।

আরজি করের আর্থিক দুর্নীতি মামলায় তৎপর ইডি, একাধিক জায়গায় তল্লাশি

একই সুর দেবাশিসের ঠিক পাশের বহুতল পারুল অ্যাপার্টমেন্টের আবাসিক শুভব্রত সাধুর। তিনি বলেন, ‘গোটা কেষ্টপুর ওঁকে গরিবের ডাক্তার বলে চেনে। আমার মায়ের চিকিৎসাও ওঁর হাতেই হয়েছে।’ ওই বহুতলেরই আর এক অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি কর্মী দেবকুমার দে-ও হতবাক! তিনি বলেন, ‘এত খারাপ লাগছে যে ওঁর বাড়ির সামনে আমাদের যে বারান্দাটা রয়েছে, সেখানে বেরোতেই পারছি না।’

তিনি জানান, ২০২০-র গোড়া পর্যন্ত রোজ সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে বাড়িতেই প্রায় ৩০-৩৫ জন রোগী দেখতেন দেবাশিস। করোনা পর্ব মিটে যাওয়ার পরে তিনি নিজেই এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে বাড়ির চেম্বারে রোগী দেখা একপ্রকার ছেড়েই দেন।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version