‘চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন…।’ কবি শ্রীজাত’র লেখা এই গানের লাইন ফেসবুকে শেয়ার করে এক নেটিজেন লিখেছেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে একটি বই খোঁজা দুপুর, প্রিন্সেপ ঘাটের পড়ন্ত বিকেল, শীতের রোদ্দুরে ইডেনে টেস্ট, ডার্বিতে যুবভারতীর একলাখি গ্যালারির মতোই স্মৃতিমেদুর ট্রামে চেপে বর্ষার ময়দান কিংবা দুপুরের কলেজ স্ট্রিট। বন্ধ হচ্ছে আর একটি ঐতিহ্য, শুধু মনে হচ্ছে এফএম-এ বেজে চলেছে, ‘আহা উত্তাপ কত সুন্দর…।’কলকাতার বুক থেকে চিরতরে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নাগরিক সমাজে বিস্ময়, ক্ষোভ, বেদনা, নস্ট্যালজিয়ার মিশেলে নতুন এক প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। কলকাতার দেড়শো বছরের ট্রাম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গত দু-দিনে দেশ-বিদেশ থেকে অজস্র পোস্ট হয়েছে। ট্রাম নিয়ে ইলাস্ট্রেশন, ফিল্মের দৃশ্য, কবিতা ও গানের লাইন, অজস্র পুরনো ফোটোগ্রাফ পোস্ট হয়ে চলেছে। অভিনেতা, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, চিত্রশিল্পী—নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ কলকাতার ট্রাম নিয়ে তাঁদের মনের কথা বলছেন।

ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’-এ ভূষিত প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ চিন্ময় গুহ সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজ্য সরকারের ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখেছেন, ‘ট্রাম চড়েছি প্যারিসে, জেনিভায়, ভিয়েনায়, আমস্টারডামে, বার্নে, ফ্র্যাঙ্কফুটে, ব্রাসেলসে..। আমার বাবা ট্রামে চড়তেন, আমি ট্রামে করে ইস্কুলে যেতাম। ট্রাম আমাদের ইতিহাসে আঁকা আছে।’

কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই এমিরেটাস অধ্যাপক ট্রামের সঙ্গে সমর সেন, জীবনানন্দ দাস, সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন। অভিনেতা-সঞ্চালক মীর ট্রামের কনডাক্টর হিসেবে নিজের অভিনীত একটি দৃশ্যের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। সেই ছবির ক্যাপশন, ‘ছিল, আছে, থাকবে।’ নস্ট্যালজিক মীর পোস্টে লিখেছেন, ‘গপ্পটা কিন্তু ট্রামে খুব জমত… শৈশবের সঙ্গে আমার। আমরা দুই বন্ধু একা একা লাইন ধরে হেঁটেছি বহু দিন।’

এই পরিস্থিতির মধ্যেই বুধবার হাইকোর্টে কলকাতার মেয়র ও পুলিশ কমিশনারের তরফে অতিরিক্ত হলফনামা দিয়ে একটি রুট ছাড়া শহরের বাকি সব রুট থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। এই সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার শ্যামবাজার ট্রাম ডিপো থেকে টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো পর্যন্ত শহরের ছ’টি ডিপোর সামনে বড় প্রতিবাদ কর্মসূচি হতে চলেছে। শ্যামবাজারে ‘সেভ হেরিটেজ সেভ ট্রাম’ ব্যানারে বড় জমায়েতের পরিকল্পনা হয়েছে।

এই প্রতিবাদের দিকে তাকিয়েই কলকাতার অন্যতম আইডেনটিটি যে ট্রাম–তা তুলে ধরতে শুরু করেছেন নেটিজেনরা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের একাধিক ছবিতে ট্রামের দৃশ্য থেকে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোয় কিছু বছর আগে অমিতাভ বচ্চনের শুটিংয়ের ছবি শেয়ার হচ্ছে। ট্রামের রেফারেন্স থাকা কবিতা, উপন্যাসের অংশ শেয়ার করা হচ্ছে।

ট্রাম তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে মত জোড়াফুলের অন্দরেই

গত শতকের নয়ের দশকের একবারে শেষের দিকে সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্ররা দলে দলে বিভিন্ন মাধ্যমে ট্রামের ছবি এঁকেছেন। সেই দলের অগ্রণী মুখ চিত্রশিল্পী অনন্ত মণ্ডলের কথায়, ‘আমার কাছে কলকাতা মানেই ট্রাম। ট্রাম ছাড়া কলকাতা ভাবা যায় না। বড়বাজার, বালিগঞ্জ, কালীঘাটে ট্রামের বহু পেইন্টিং করছি। ট্রাম বন্ধ হওয়ার খবরে মন খুব খারাপ।’ প্রবাসী বাঙালিরাও সরব হয়েছেন।

স্পেনের মাদ্রিদে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শুভ্রসুন্দর সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘অন্তত ৪০টি প্রাইভেট কার অথবা অটোয় যে যাত্রী থাকে, সেই যাত্রী একটি ট্রামে থাকে। ট্রাম যানজট কমিয়ে দেয়, তাই বহু দেশে নতুন করে ট্রাম পরিষেবা চালু হচ্ছে। মাদ্রিদে ৩৫০-র বেশি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। ট্রামও রয়েছে।’ ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা বাঙালি শিল্পী জয়মালা গুহ মার্কিনি ট্রামের ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘দেখে এলাম সে শহরে, সবাই আজও ট্রামে চড়ে। আমার শহর জানে না রাখতে, পুরনোকে আপন করে।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version