আদালতের নিয়ম মেনে বাংলায় কোনও কমার্শিয়াল গাড়ি ১৫ বছরের বেশি চালানো যাবে না। কলকাতার হলুদ অ্যাম্বাসাডর মিটার ট্যাক্সিগুলির অধিকাংশই এই নিয়মের কারণে আর বছর তিন-চারেকের মধ্যে বসে যাওয়ার কথা। তথ্য বলছে, শেষ হলুদ অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সিটির রেজিস্ট্রেশনের সময় ধরলে, সেটির বসে যাওয়ার কথা ২০২৭-এ।
এই পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কেউ যদি তাঁর কমার্শিয়াল সেডান বা হ্যাচব্যাক হলুদ রঙের করেন এবং সরকারের বেঁধে দেওয়া কিছু শর্ত মানেন, তা হলে সেই সব গাড়িতে মিটার বসানোর অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তেও কি বাঁচানো যাবে হলুদ ট্যাক্সি? নাকি ক্যাবের এই রমরমার যুগে শেষ পর্যন্ত চিরতরে হারিয়েই যাবে কলকাতার অন্যতম এই লাইফলাইন?
মুম্বইয়ের অন্যতম ‘জান’ কালি-পিলি (কালো-হলুদ রঙের প্রিমিয়ার গাড়ি) গত বছরই উঠে গিয়েছে। সেখানে এখন পুরোটাই অ্যাপ-ক্যাব। কিন্তু কলকাতা এবং কলকাতা লাগোয়া হাওড়া, হুগলি এবং দুই চব্বিশ পরগনার শহরাঞ্চলে এখনও প্রায় ১৭ হাজার হলুদ ট্যাক্সি রয়েছে (পরিবহণ দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী)। কিন্তু কত দিন আর থাকবে? এই প্রশ্ন উঠছে একাধিক কারণে। প্রথম, অ্যাম্বাসাডর গাড়িই আর তৈরি হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, মাইলেজ থেকে চালানোর সুবিধে বা মেনটেন্যান্স — একাধিক কারণে বিভিন্ন কোম্পানির সেডান এবং হ্যাচব্যাক, অ্যাম্বাসাডরকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এই সব গাড়ি চালানো যেমন সুবিধে, তেমনই যাত্রীরা অ্যাম্বাসাডরের তুলনায় অনেক বেশি আরামে যাতায়াত করতে পারেন। তৃতীয়ত, ট্যাক্সির মিটারও আজকাল তেমন ভাবে আর তৈরি হচ্ছে না। চতুর্থ এবং সম্ভবত সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সরকার বেশ কিছু ছাড় দিলেও ট্যাক্সি-মালিক এবং চালকদের একটা বড় অংশের দাবি, মিটারে গাড়ি চালিয়ে তেমন লাভ নেই।
কারণ দীর্ঘদিন হলো ট্যাক্সির ভাড়া বাড়েনি, অথচ তেলের দাম চড়চড় করে বেড়েছে। এই অবস্থায় পুরোনো রেটে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। এবং সে কারণেই ট্যাক্সিচালকরা মিটারে যেতে চান না। অথচ অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি চালালে ভাড়া বাবদ অনেক বেশি টাকা পাওয়া যায়। সেখানে ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে দরদাম ঘিরে ঝামেলার সম্ভাবনাও কম। পোষালে যাত্রী বা চালক গন্তব্যে যাবেন, নইলে রাইড ক্যানসেল করার রাস্তা তো খোলাই রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এত দিন অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সিগুলিকে মিটার বসানোর অনুমতি দেওয়া হলেও এ বার থেকে কেউ সেডান এবং হ্যাচব্যাক হলুদ রঙের করলে, তাতেও আবেদনের ভিত্তিতে মিটার বসানোর অনুমতি দেওয়া হবে। রাজ্যের পরিবহণ সচিব সৌমিত্র মোহন জানিয়েছেন, সেডান ও হ্যাচব্যাক গাড়িকে মিটার ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে গাড়িতে চালক-সহ অন্তত পাঁচ জনের বসার জায়গা থাকতে হবে। ইঞ্জিনের ক্যাপ্যাসিটি হবে ৯০০-১১৫০ সিসি। গাড়িতে পেট্রল, সিএনজি এবং ডিজেল— এই তিন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করার সংস্থান থাকতে হবে।
কিন্তু যেখানে হলুদ রঙের মিটার ট্যাক্সিই উৎপাদন এবং উৎসাহের যুগপৎ অভাবে উঠে যাওয়ার মুখে, সেখানে নতুন করে সরকার মিটার নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিল কেন? পরিবহণ দপ্তরের আধিকারিকদের একাংশের ব্যাখ্যা, আদালতের নির্দেশে ১৫ বছরের পুরোনো কমার্শিয়াল গাড়ি এমনিতেই আর চালানো যাবে না। তা ছাড়া এখন নতুন করে কেউ হলুদ ট্যাক্সি আর কিনতেও চাইছেন না। কিন্তু মিটার হলো সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়া। যেটা সরকার নিজে থেকে তুলে দিতে পারে না। তাই সরকারকে মিটার বসানোর রাস্তা খোলা রাখতেই হবে। এ বার মালিক বা চালকরা মিটারে গাড়ি চালাবেন না অ্যাপের মাধ্যমে, সেটা তাঁদের ব্যাপার।
এতে কি মিটার ট্যাক্সি বাঁচবে? পরিবহণ দপ্তরের এক অফিসারই বললেন, ‘এমনিতেই ট্যাক্সিচালকরা কেউ এখন মিটার ব্যবহার করেন না। যে যাঁর মতো ভাড়া হাঁকেন। তা ছাড়া মিটার ট্যাক্সির তুলনায় অ্যাপ ক্যাবে রোজগার অনেক বেশি হয়। তাই কারও কাছে সেডান থাকলে তিনি কি আর সরকারের বেঁধে দেওয়া শর্ত মেনে তা সরকারি রেটে মিটারে চালাবেন?’ বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বলবিন্দর সিং বলেন, ‘অ্যাম্বাসাডরের উৎপাদন বন্ধ। ইলেকট্রনিক মিটারও আর কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কেউ সেডান কিনলে অ্যাপের মাধ্যমেই চালাবেন। রোজগারও বেশি হবে। সরকার যা-ই করুক না কেন, কলকাতা থেকে একদিন হলুদ মিটার ট্যাক্সি শেষ পর্যন্ত উঠেই যাবে।’