ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেনাবাহিনীতে লড়াই করছে মেয়েরা। ওড়াচ্ছে যুদ্ধবিমান। পাড়ি দিচ্ছে মহাকাশে। তা হলে খনির কাজে কেন বৈষম্য থাকবে? খনিতে কর্মরত অবস্থায় বাবা বা মায়ের মৃত্যু হলে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে সেই চাকরি শুধু ছেলেরাই পাবে কেন? কেন বাদ থাকবে মেয়েরা? দীর্ঘ বহু বছর ধরে চলে আসা ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেডের (ইসিএল) এই নিয়ম এ বার খারিজ হলো সুপ্রিম কোর্টে।আরজি করের ঘটনার পর রাতে হাসপাতালে মেয়েদের যতটা কম সম্ভব ডিউটি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল রাজ্য। তবে এই উদ্যোগ মেয়েদের সমানাধিকার ক্ষুণ্ণ করছে— এই যুক্তিতে লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বাতিল করতে বলে সুপ্রিম কোর্ট। কোলিয়ারিতে কর্মরত অবস্থায় বাবা বা মায়ের মৃত্যুতে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে সন্তানের চাকরির ক্ষেত্রে চলে আসা লিঙ্গ-বৈষম্যেও এ বার যবনিকা টানল আদালত। অন্য ক্ষেত্রের তুলনায় কোলিয়ারিতে কায়িক শ্রম অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রেও বৈষম্যের ঠাঁই নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে আদালত।

প্রয়াত কর্মীর কন্যা-সন্তানকে চাকরিতে বঞ্চিত করার মামলায় গত অগস্টে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ চার সপ্তাহের মধ্যে চাকরিপ্রার্থী সুকুমনি হেমব্রম (মেঝান)-কে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিল। সে নির্দেশ মানেনি ইসিএল। আদালত অবমাননার মামলা চলাকালীনই হাইকোর্টের অগস্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিল ইসিএল।

সম্প্রতি বিচারপতি জেকে মাহেশ্বরী ও বিচারপতি রাজেশ বিন্দলের বেঞ্চ ইসিএলের আপিল পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়ে জানিয়েছে, হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকবে। চার সপ্তাহের মধ্যে সুকুমনিকে নিয়োগ করতে হবে। এই রায় খনিশ্রমিক পরিবারের কন্যাসন্তানদের বঞ্চিত হওয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে ইতি টানবে বলেই আশাবাদী সুকুমনির আইনজীবী অমৃতা দে।

ইসিএলের কেন্দা এরিয়ার সিদুলি কোলিয়ারিতে কাজ করতেন সোমরা মাঝি। কর্মরত অবস্থায় ২০১৫-র মে মাসে মারা যান। তার আগেই ইসিএলের নিয়ম অনুযায়ী সার্ভিসবুকে তাঁর উপরে নির্ভরশীল হিসেবে মেয়ে সুকুমনির নাম নথিভুক্ত করেছিলেন সোমরা। কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরির ক্ষেত্রে এটা জরুরি। তবে বাবার মৃত্যুর সময়ে সুকুমনি ছিলেন নাবালিকা। আবার তাঁর ভাইও মারা যান বাবার মৃত্যুর কিছুদিন আগে।

সুকুমনি আর তাঁর মা লক্ষ্মী মেঝানের অস্তিত্বরক্ষার লড়াই সেই সময় থেকেই। দারিদ্রের সঙ্গে যুঝে সুকুমনি একে একে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ২০২১-এ স্নাতকও হন। সে বছরই কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরির আবেদন করেন ইসিএল কর্তৃপক্ষের কাছে। লক্ষ্মী মেঝানও চিঠি দিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানান, সোমরা মাঝির মৃত্যুর পর কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরির একমাত্র বৈধ দাবিদার সুকুমনিই। কিন্তু কাজ তিনি আর পাননি।

অনেক দৌড়োদৌড়ি করেও সুরাহা না-পেয়ে আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী এবং অমৃতা দে-র সাহায্যে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন সুকুমনি। সিঙ্গল বেঞ্চ তাঁর আর্জিতে কর্ণপাত করেনি। ইসিএল যুক্তি দেয়, ন্যাশনাল কোল ওয়েজ এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী, কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরির জন্যে নির্দিষ্ট লাইভ রস্টারে প্রয়াত কর্মচারীর নাবালক পুত্রসন্তানকে সাবালকত্বে পৌঁছনোর পরে বিবেচনা করা গেলেও কন্যাসন্তানের সে সুযোগ নেই।

ডিভিশন বেঞ্চে অবশ্য ন্যাশনাল কোল ওয়েজ এগ্রিমেন্টের ধারা দেখিয়েই আইনজীবী রঘুনাথ এবং অমৃতা প্রমাণ করেন, কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরিতে পুত্র-কন্যার মধ্যে বৈষম্যের সুযোগ নেই। সাংবিধানের ১৪ ও ১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ীও বৈষম্য বেআইনি। এই যুক্তিতেই সিলমোহর দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। শীর্ষ আদালতও এই রায় বহাল রাখল।

এতদিন পরে আশার আলো দেখতে পেয়ে সুকুমনি বলেন, ‘মা আর আমি দশ বছর ধরে অনেক কষ্ট সয়েছি। অনেকে সাহায্য করেছেন বলে এতদূর লড়াই করতে পেরেছি।’ অমৃতার বক্তব্য, ‘খনি এলাকায় সুকুমনির মতো অনেক বঞ্চিত মেয়ে রয়েছেন। গরিব পরিবারগুলি এ বার হয়তো সুরাহা পাবে।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version