রাজেন্দ্রনাথ বাগ
ক’দিন আগেই কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ বীরভূমের মল্লারপুর থানার হেফাজতে এক বালকের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নজিরবিহীন নির্দেশ দিয়েছিল। এ বার তিরিশ বছর আগে রানাঘাট থানার হেফাজতে এক বালককে পিটিয়ে মারার ঘটনায় পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দায়রা আদালত অভিযুক্তদের বেকসুর খালাসের যে রায় দিয়েছিল, তা খারিজ করল হাইকোর্ট। ফের সওয়াল-জবাব চালিয়ে নতুন করে রায় দিতে দায়রা আদালতে নথি ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরী।

১৯৯৩-র বড়দিনের রাতে বেগোপাড়া চার্চে অনুষ্ঠান দেখতে, খাবারের আশায় গিয়েছিল রানাঘাট সড়কপাড়ার বাসিন্দা, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, বছর তেরোর এক বালক। মাঝরাতে পাউরুটি খেতে খেতে ফেরার সময়ে সিদ্ধেশ্বরীতলার কাছে নাইটগার্ডরা তাকে চোর সন্দেহে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে বেধড়ক মারধর করে। পরদিন ভোরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

Recruitment Scam : টাকা নিয়ে চাকরিতে, দীপক জানাকে নিয়ে অনুসন্ধানে সিবিআই
সকাল আটটা নাগাদ মহকুমা হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসক রিপোর্টে লেখেন, পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ আর একটু ফোলা ছাড়া অস্বাভাবিক কিছু নেই। অভিযোগ, থানায় নিয়ে গিয়ে চলে বেদম প্রহার। কোর্টে তোলার সময়ে তার হাঁটাচলার ক্ষমতাও ছিল না। চ্যাংদোলা করে পুলিশ তাকে আদালতের লক-আপে ঢোকাতে গেলে ছেলেটির অবস্থা দেখে আপত্তি জানান স্বয়ং জিআরও।

Calcutta High court : মায়ের জীবনরক্ষায় নাবালিকার গর্ভপাতের আর্জিতে না কোর্টের
পরে তাকে পুলিশের চাপে লক-আপে রাখা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ওই নাবালককে জুভেনাইল হোমেও নয়, একেবারে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু আগে লক-আপেই নেতিয়ে পড়ে ওই বালক। সুরতহাল করতে এসে ম্যাজিস্ট্রেট দেহ ওল্টাতেই ছেলেটির পকেট থেকে বেরিয়ে পড়ে আগের রাতের না-খেতে পারা পাউরুটির টুকরো!

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রিপোর্ট দেন, বালকের শরীরে অসংখ্য গুরুতর আঘাত, দু’পায়ে কালশিটে, বাঁ-পায়ের মালাইচাকি ভাঙা, হাঁটু সরে গিয়েছে, হাত-পা ফোলা, নাকমুখে রক্ত জমে, বাঁ ফুসফুসও ছিন্নভিন্ন। ছেলের খোঁজে আগের রাত থেকে হন্যে বালকের বাবা, পেশায় ট্রেনে ঝালমুড়ি বিক্রেতা শেষ পর্যন্ত ছেলেকে দেখতে পান লাশকাটা ঘরে।

TET Recruitment : প্রাথমিকে নিয়োগ প্রসঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ খারিজ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের
পুলিশ, নাইট গার্ডদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হয়। তবে পুলিশ সব অভিযোগ উড়িয়ে রিপোর্ট দেয় কোর্টে। বালকের বিরুদ্ধে টিন চুরির মামলা সাজায়। রানাঘাটের এসডিজেএম কোর্ট পরিবারের তরফে আর্জিতে সায় দিয়ে ১৯৯৫-এর ৬ মার্চ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। তা করে রাজ্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গেলেও ১৯৯৯ সালে সিবিআই তদন্তেই সিলমোহর দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

West Bengal Latest News : সোনারপুরে অভিনব প্রতারণা চক্র, অনলাইনে গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে সাবধান!
ওই বালকের মৃত্যুর জন্যে থানার তদানীন্তন ওসি তারকনাথ চট্টোপাধ্যায় ও এএসআই ষষ্ঠীগোপাল পালকে দায়ী করে ২০০১-এ কৃষ্ণনগরে নদিয়া জেলা আদালতে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। বালকের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ মিথ্যে বলেও রিপোর্ট দেয়। সাক্ষীদের বয়ান, নথিপত্রে পুলিশি হেফাজতে নিগ্রহের পর্যাপ্ত প্রমাণ মিললেও ২০০৯-এর অগস্টের রায়ে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করে দেয় কৃষ্ণনগরের চতুর্থ দায়রা আদালত।

তিন দশক ধরে আগাগোড়া পরিবারের পাশে থেকেছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর রানাঘাট শাখা আর আইনজীবী শুভাশিস রায়। সোমবার শুভাশিসই হাইকোর্টে শুনানিতে ঘটনা পরম্পরা তুলে ধরেন। তার পরেই বিচারপতি খালাসের রায় খারিজ করেন। বালকের বাবার মন্তব্য, ‘আমার তো দিন শেষ হয়ে এল। এটুকুই আশা, সন্তানের হত্যাকারীর শাস্তি যেন দেখে যেতে পারি।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version