গৌতম বসুমল্লিক

‘মমি’ শব্দটা শুনলে প্রথমেই মনে পড়ে মিশরের কথা। সেখানকার মরু এলাকার সারি সারি পিরামিডের মধ্যে এক সময়ে থাকত সেখানকার সম্রাট-সম্রাজ্ঞী ও বিশিষ্টজনেদের সংরক্ষিত করা মৃতদেহ। যেহেতু সেগুলো মানুষের মৃতদেহ তাই ‘মমি’ শব্দের সঙ্গে জুড়ে থাকে একটা গা ছমছমে ভাব। আর সেটা অনুভব করা যেতে পারে কলকাতার ‘ভারতীয় প্রদর্শশালা’ বা ‘ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম’-এ গেলেই!

Kolkata News : রবি ঠাকুরের নামে আস্ত এক ডাইনোসোর আছে কলকাতায়! জানেন কোথায়?

কী ভাবে কলকাতায় এল মিশরের মমি?

হ্যাঁ,এই শহরের ‘ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম’-এ রয়েছে একটা পূর্ণাঙ্গ মিশরীয় মমি। একটা মমির হাতের কাটা অংশ। কী করে ওই মমিগুলো কলকাতায় এল তা জানতে গেলে চোখ ফেরাতে হবে ইতিহাসের পাতায়।

উদ্ভিদবিদ নাথানিয়েল ওয়ালিচের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটির বিভিন্ন সংগ্রহ নিয়ে ১৮১৪-র ২ ফেব্রুয়ারি সোসাইটির ভবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক প্রদর্শশালা। পরে সেটি রূপান্তরিত হয় ভারতীয় প্রদর্শশালা বা ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ম-এ। চৌরঙ্গি রোডের বর্তমান মিউজিয়ম-বাড়িতে সেটি উঠে আসে ১৮৭৮-এ। পুরনো জিনিস সংগ্রহের নিরিখে এক সময়ে কলকাতার এই প্রদর্শশালাকে তুলনা করা হতো লণ্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ম ও অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা মিউজিয়মের সঙ্গে। স্থপতি ডব্লিউ এল গ্র্যানভিল ১৮৬৭ সালে ওই ভিক্টোরিয়ান যুগের স্থাপত্যের ভবনটির ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৭৫ সালে। আর ১৮৭৮ সালে সেটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

Kolkata Yellow Taxi : কলকাতার ‘বিলুপ্তপ্রায়’ হলুদ ট্যাক্সি পুনরুজ্জীবিত করতে এবার অভিনব উদ্যোগ
১৯৩৪ সাল নাগাদ, গোর্বা (Gourvh)-র রাজাদের সমাধি থেকে সংগ্রহ করা একটা মমি মোকা (Mocha) থেকে আনার কথা হয়েছিল। আনন্দের খবর সন্দেহ নেই! কারণ তখনও পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটির ওই মিউজিয়মে কোনও মিশরীয় মানুষের মমি সংগৃহীত হয়নি। কিন্তু পরে জানা গেল, কুটে নামের যে রণতরীতে চাপিয়ে মমিটাকে বোম্বাই পর্যন্ত আনবার কথা ছিল, জাহাজের মুসলমান নাবিকদের বিরোধীতায় সেটা আনা সম্ভব হচ্ছে না। ওই নাবিকেরা জানিয়েছেন, মৃত শরীরকে কবর থেকে তুলে জাহাজে করে স্থানান্তরিত করা তাদের সংস্কার-বিরুদ্ধ, তাই সে কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অবস্থা এমনই হয়ে দাঁড়ায় যে মমিটাকে মোকার বাইরে আনার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়।

Papua New Guinea : পাখির শিস নয়, পাখির বিষ!

কলকাতায় পূর্ণাঙ্গ মমি!

সেই ঘটনার প্রায় বছর পঞ্চাশেক পরে, ১৮৮২ সালের কাছাকাছি, মিশরের কোনও এক সমাধিক্ষেত্র থেকে একটা পূর্ণাঙ্গ মমি কলকাতায় এসে পৌঁছয় এবং তার ঠাঁই হয় ইন্ডিয়ান মিউজিয়মে। যদিও ঠিক কোন তারিখে মমিটা কলকাতায় এসেছিল তা নথিবদ্ধ করা নেই ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের কোনও কার্যবিবরণীতে।

ইতিমধ্যে, ১৮৭৮ সালে, এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়ি থেকে চৌরঙ্গি রোডের নিজস্ব ভবনে উঠে এসে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদর্শশালা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে মিউজিয়ম। ১৮৮৩ সালের প্রদর্শশালার দ্রষ্টব্য-বিবরণীতে ওই মমির উল্লেখ দেখে অনুমান করা হয়, ১৮৮০ থেকে ১৮৮২-র কাছাকাছি কোনও এক সময়ে মমিটা ভারতীয় প্রদর্শশালায় এসেছিল। বলা হয়ে থাকে, মমির গন্তব্য ছিল অন্য কোথাও। কিন্তু কোনও এক ‘ভূতে পাওয়া’ জাহাজের অফিসার মমিটাকে জাহাজ থেকে খালাস করে মিউজিয়মে দিয়ে গিয়েছিলেন।

WBTC Bus: রাজ্যে আসছে আরও CNG ও E Bus, কবে থেকে নামবে রাস্তায়?
ইন্ডিয়ান মিউজিয়মে রাখা ওই মমির দেহ বিচিত্র রঙের লিনেন জাতীয় কাপড়ে জড়ানো এবং ওই কাপড় দিয়েই হাত-পা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। শুধু মুখের অংশটা খোলা। মুখের চামড়া, মাংস ভেদ করে কঙ্কাল দেখা যায়। অক্ষি-কোটর ক্ষতবিক্ষত। মমির বুকের কাছে রয়েছে মানুষের মুখের আদলে আঁকা একটি মুখোশ। যে বাক্সর মধ্যে মমিটি রাখা আছে, তার চার কোণে বাতাসের আদ্রতা শুষে নেওয়ার জন্য সিলিকা জেল রাখা আছে। আছে আদ্রতা মাপার মিটার ইত্যাদি। বাক্সর ঢাকনির ভেতরেও মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা।

কলকাতায় ভারতীয় জাদুঘরে মিশরের মমি। সৌজন্যে-Indian Museum

পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের মমি পরে এলেও কায়রোর কাছে কোনও এক পিরামিড থেকে সংগ্রহ করা আনুমানিক তিন হাজার বছরের পুরনো কোনও এক মমির কাটা হাত (পাঞ্জা) কিন্তু যাদুঘরে এসে গিয়েছিল সেই ১৮৪৪ সালেই। এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারের সহ-গ্রন্থাগারিক ডবলিউ সি কটনের উদ্যোগে এসেছিল সেটা।

Alipore Zoo : নতুন সাজে ‘ভার্চুয়াল সাফারি’ ফেরাবে আলিপুর চিড়িয়াখানা

ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার সাক্ষী মিউজিয়ামের কর্মীরা

সোসাইটির কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সোসাইটির মিউজিয়মে ওই মমির কাটা হাত উপহার দেওয়ার দিন বিশেকের মধ্যে তিনি মারা যান। ঘটনাটা কাকতালীয় হলেও মমির কাটা পাঞ্জা, উপহারদাতার আকস্মিক মৃত্যু— সব মিলিয়ে যে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। দীর্ঘ কাল পর্যন্ত ওই হাতটি কার, কী করে মৃত্যু হয়েছিল তার এ সব বিষয়ে কিছুই জানা ছিল না। কিছুকাল আগে হাতটির এক্স-রে করে শুধু জানা গিয়েছে সেটা কোনও এক নারীর হাতের অংশ।

ভারতীয় প্রদর্শশালা নিয়ে বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, মিউজিয়মের পুরনো কর্মীদের অনেকেই নাকি রাতে পাহারা দেবার সময়ে ওই মমি এবং অন্যান্য মৃত মানুষ-পশুর ঘরগুলি থেকে নানা রকম ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা লাভ করতেন! তবে সে সব কাহিনি নেহাতই মিউজিয়মকর্মীদের মনের ভয় বলে মনে করা যেতে পারে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version