টোটো হাতে বছর ১৫-র গায়ত্রী হালদার আজ গাইঘাটা এলাকার সকলের পরিচিত মুখ। সকাল হলেই টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। মাঝে কিছুটা সময় স্কুলে পড়াশোনা। তারপর আবারও টোটো নিয়ে যাত্রীদের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ায় কাজ। আর যাত্রী পরিষেবা দিয়ে তাঁর উপার্জন করা অর্থেই এখন চলছে গোটা সংসার। কারণ গত কয়েক বছর আগে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বাবা অলোক হালদার শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় সংসারের হাল ধরতে জেদ করেই টোটো চালানো শেখা গায়ত্রীর।

কোনোরকমের টালির চাল দেওয়া বাড়িতে অসুস্থ বাবা, মা ও দিদিকে নিয়ে সংসার গায়ত্রীর। শুধু সংসারের হাল ধরাই নয়, পাশাপাশি দিদির পুলিশ হওয়ার ইচ্ছেকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে বোন হয়ে দিদির পাশে দাঁড়িয়েছে গায়ত্রী। ছোট মেয়ের সংসার চালানোর এই লড়াই দেখে, মা কৃষ্ণা হালদারও আজ এলাকার দুটি বাড়িতে ধরেছেন পরিচারিকার কাজ। এলাকার মানুষও গায়ত্রীর এই লড়াইকে আজ কুর্নিশ জানাচ্ছেন।

Alipurduar News : সৎ মায়ের তাণ্ডব! পাড়াতুতো কাকুর সাহায্য চেয়ে বড় বিপদে নাবালিকা
তবে প্রতিমুহূর্তে প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে গায়ত্রীকে এগিয়ে যেতে হয় টোটো নিয়ে। প্রথম অবস্থাতে নানা বিদ্রুপ কটুক্তির শিকার হতে হয়েছে ছোট্ট মেয়েটিকে। তবে তাঁর লড়াইয়ের কাছে মাথা নত করতে হয়েছে সকলকে। এখন টোটো স্ট্যান্ডের সকলেই এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীরাও সবরকমভাবে সাহায্য করেন বছর ১৫-র টোটো চালক গায়ত্রীকে।

মেয়ের এই লড়াই রীতিমত চোখে জল এনে দিচ্ছে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী বাবা অলোক হালদারের। শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে মেয়েকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন অলোক বাবু। তিনি বলেন, ‘আমি চাই না আমার মেয়ে টোটো চালাক। তাতে ওর পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। আমি খুবই দুর্বল, বাঁ হাত কাজ করেনা। সেই কারণে আমি বেরোতে পারিনা বাড়ি থেকে। তাই উপায় না থাকলেও ওকে টোটো চালাতে হচ্ছে।’

Toto Rickshaw : বৃষ্টির মধ্যে টোটো চার্জ দিতে বিপত্তি! মর্মান্তিক পরিণতি চালকের
বাবার চিকিৎসা খরচ থেকে শুরু করে দিদির পড়াশোনা এমনকি বাড়ির সকলের খেয়াল রাখার পাশাপাশি নিজের সমস্ত শখ ভুলে সকাল বিকেল টোটো চালিয়েই অর্থ উপার্জন করতে হয় বছরে ১৫-এর এই ছোট্ট মেয়েটিকে। স্থানীয় ঢাকুরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকারাও আজ তার পাশে। গায়ত্রী টোটো চালানোর পাশাপাশি পড়াশোনা করুক, তার জন্যই সর্বতোভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।

সকাল বিকেল টোটো চালানোর মাঝেই স্কুলে যায় গায়ত্রী। তবে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের ব্যবহার নিয়ে আক্ষেপের সুর গায়ত্রী গলায়। ছোট বয়সে গায়ত্রী আজ টোটো চালক। তাই হয়তো ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীরা সেভাবে কথা বলে না তার সঙ্গে। তাই স্কুলে আসলেও মানসিকভাবে একাই কাটাতে হয় জীবনযুদ্ধে লড়াই করা বছর ১৫-র গায়ত্রী হালদারকে।

Hooghly News : লোহার শিকলে মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে বেঁধে রেখেছেন মা, ব্যান্ডেলের কাজলের করুণ কাহিনি জানেন?
যে কথা বলতে গিয়ে রীতিমত চোখের জল চলে আসলো নবম শ্রেণীর এই ছাত্রীর। সে বলে, ‘আমি তো শখ করে রাস্তায় টোটো চালাতে নামিনি। আমার পরিবারের অবস্থা যেরকম, তাতে আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। আর সেই কারণে কেউ যদি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তখন একটু খারাপই লাগে। আমি মনে করি, জীবনে সৎ ভাবে করলে কোনও কাজই খারাপ না। আমার এখন লক্ষ্য দ্রুত বাবাকে সুস্থ করে তোলা।’

তাঁর এই কথাতেই বোঝা যায়, টোটো নিয়ে রাস্তায় নেমে নানা বিদ্রুপ কটুক্তির শিকার হয়েও আজ যেন জয়ী সে। এমন একদিন আসবে যেদিন বান্ধবীরাও তার এই কষ্টকে কুর্নিশ জানিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে, আশা গায়ত্রীর। সরকারিভাবে কোনও সাহায্য মেলেনি।

WBCS Result : ছাত্র পড়িয়ে কোচিংয়ের ফি জোগাড়! অভাবকে সঙ্গী করেই WBCS-এ সাফল্য পেলেন মালদার রকি
গায়ত্রী এখন চায় সরকারি সাহায্য হোক বা যেভাবে হোক বাবাকে সুস্থ করে তুলতে। এত অল্প বয়সে পরিবারের হাল ধরতে কজনই বা পারে! তাই টোটো চালক গায়ত্রী যেন আজ সমাজে লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। তবে মানসিকভাবে একা হওয়া গায়ত্রীর শুধু মাত্র বন্ধু আজ এই টোটোই।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version