গৌতম বসুমল্লিক
হাল্কা নেশার পানীয়ের মধ্যে, চায়ের ব্যবহারই বোধ হয় সর্বাধিক! চা জিনিসটা যেমন অনেক রকমের হয়, বাজার থেকে কিনে তাকে পান করবার উপযোগী করে প্রস্তুত করার পদ্ধতিও অনেক। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম স্বাদের চা পান করতে ভালোবাসেন। কেউ যেমন গরম জলে শুধু চায়ের পাতা ফেলে লিকার-চা খেতে পছন্দ করেন, অনেকে আবার সেই লিকারের সঙ্গে দুধ আর চিনি মিশিয়েও পান করতে ভালোবাসেন। আসলে চায়ের লিকারের স্বাদটা একটু কড়া ও তেতো। তার সঙ্গে অল্প শর্করা জাতীয় কিছু মিশিয়ে নিলে সেই তিক্ত স্বাদটা অনেকটাই কমে যায়, ফলে চা পানের গ্রহণযোগ্যতাও। সেই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন টং আছু নামে এক চিনা বণিক, আজ থেকে দুশো চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে। ঘটনাটা একটু খুলেই বলা যাক।

স্বাধীনতা দিবসের বিকেলের স্ন্যাক্সে রাখতে পারেন ‘তিরঙ্গা সুজির ধোকলা’
টং আছু নামের ওই চিনা বণিক জাহাজভর্তি চা নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে হুগলি নদীতে ঢুকে পড়েন ব্যবসা করবার জন্য। বজবজের কাছে এসে তাঁর জাহাজ গেল আটকে। স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে তিনি ডাঙায় পৌঁছুলেন, তাঁদের সাহায্যে চিনা সাহেবদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও হল। বিনিময়ে তিনি গ্রামবাসীদের খাওয়ালেন একেবারে নতুন এক পানীয়— চা। চিন থেকে চায়ের সঙ্গে তিনি কিছু চিনিও এনেছিলেন। আছু সাহেব লক্ষ্য করলেন, র-লিকার তিতকুটে লাগলেও, সঙ্গে একটু চিনি মিশিয়ে স্বাদটা মিষ্টি করে দিলে গ্রামবাসীরা কাড়াকাড়ি করে চা নিয়ে। ব্যবসায়ীর চোখ! আছু সাহেব বুঝে নিলেন, এখানে চিনি তৈরির কল করলে লাভ আছে। চিনি-কল তৈরির জন্য জমি খোঁজা আরম্ভ করলেন তিনি।

Maddox Square : ম্যাডক্স স্কোয়ারে উপাসনালয়, বেঁধে রাখা রয়েছে গোরুও!
এই ঘটনা অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষ দিকের। বাংলার শাসনভার তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। গভর্নর জেনারেল পদে রয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। বলা হয়ে থাকে, একবার নাকি হেস্টিংসের জাহাজ ঝড়ের মধ্যে পড়ে আর আছু ও তাঁর দলবল মিলে তাঁকে রক্ষা করেন। হেস্টিংস খুশি হয়ে তাঁকে পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি চিনি-কলের জন্য জমি চেয়ে বসেন। গভর্নর জেনারেলের নির্দেশে, চিনির কল তৈরির জন্য স্থানীয় জমিদারকে খাজনার বিনিময়ে সাড়ে ছ’শো বিঘা জমি আছু সাহেবকে দেওয়া হল।

Dani Data Scam : বড় কেলেঙ্কারি! ভুয়ো বেটিং অ্যাপে 1,400 কোটি টাকা লোপাট চিনা ব্যক্তির
অতখানি জমি পেয়ে অছু ভেবে দেখলেন, চিনি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় আখের চাষ এবং কল তৈরি করেও অনেকখানি জমি তাঁর হাতে থাকবে। সেই জমিতে যদি একটা ছোট চিনা উপনিবেশ গড়বার পরিকল্পনা করলেন। এখানে প্রাথমিক ব্যবস্থাদি করে তিনি দেশে ফিরে গেলেন এবং সেখান থেকে চিনির কল তৈরির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং একদল দক্ষ শ্রমিক ও তাদের পরিবার মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক লোক নিয়ে বজবজে ফিরে এলেন।

Independence Day 2023 : স্বাধীন কারা, সাধারণ মানুষ না কি শাসকবর্গ?
বজবজ তখন সুন্দরবনের অন্তর্গত। অছুর পাওয়া জমির বেশিরভাগই ছিল জঙ্গল। আনুমানিক ১৭৮০ সাল নাগাদ, চিন থেকে আনা শ্রমিকদলের সাহায্যে সেই জঙ্গল কেটে এক দিকে যেমন তৈরি হল চিনির কল আর আখ চাষের জমি, অন্য দিকে পরিবার নিয়ে থাকার জন্য এক পাড়া। এক জায়গায় অত চিনা থাকায় লোকমুখে জায়গাটার নাম হয়ে যায় ‘চিনেম্যানতলা’। ভারতে চিনাদের প্রথম কলোনি।

History Of Theatre In Kolkata : কলকাতার সাহেবি থিয়েটারে বাঙালি নটের দাপট! পড়ুন ইতিহাস
টঙের কলে তৈরি চিনির প্রায় সবটাই চলে আসত কলকাতায়। সাহেবরা তো বটেই, সেই সঙ্গে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণিও স্বাদ পেল চিনা-চিনির। প্রথম বছর দুয়েক তাঁর ব্যবসা ভালোই চলেছিল। কিন্তু তার পর জাভা, সুমাত্রা থেকে কলকাতায় সস্তায় উচ্চ মানের চিনি আমদানি শুরু হলে আছুর চিনির কদর কমে গেল, ফলে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। ধারদেনায় জড়িয়ে পড়ে ১৭৮৩ সাধারণাব্দের ৮ ডিসেম্বর, তিনি প্রয়াত হন। ওই চিনেম্যানতলাতেই তাঁকে সমাধিস্থ করে ঘোড়ার খুরের আকৃতির সমাধিমন্দির করা হয়। মূল সমাধি গঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে গেলে পাশে একই রকম দেখতে আর একটা সমাধি তৈরি হয়। এখনও সেটা রয়েছে।

World Trending News Today: ৮০০ বছর পরও ছেলে-পুলে, নাতি-নাতনি দেড় কোটি! ‘খেলোয়াড়’ চেঙ্গিসের রহস্য ফাঁস
টং আছুর মৃত্যুর পর, চিনির কল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। গড়ে ওঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের প্রথম চিনা কলোনি ভেঙে যায়, শ্রমিকেরা সপরিবারে ধীরে ধীরে কলকাতা-সহ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। চিনা শ্রমিকরা নতুন তৈরি হওয়া কলকাতা বন্দরে শ্রমিকের কাজ নিয়ে চলে আসে। ফলে টং অছুর স্মৃতিতে পরে চিনেম্যানতলার নাম হয় ‘অছিপুর’।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version