অনির্বাণ ঘোষ

অতি সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকেই সপ্তাহ দেড়েকে সেরে যায় এই অসুখ। কিন্তু এহেন আপাত-নিরীহ টাইফয়েডই এবার ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া-ভাইরাল জ্বরের মরশুমে ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের। কেননা, নিছক হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না এ রোগ। টাইফয়েডের জীবাণু ‘সালমোনেলা টাইফি’ ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠায় সংক্রমণকে বশে আনতে রীতিমতো কালঘাম ছুটে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, টাইফয়েডে গুরুতর অসুস্থ হয়ে, এমনকী ফুটো হয়ে যাওয়া অন্ত্র নিয়েও হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন এখন অনেকেই। রোগ সারাতে বেগ পেতে হচ্ছে মহার্ঘ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও।

চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই এই পরিস্থিতির জন্য দুষছেন মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা এবং তার পাশাপাশি বাইরের খাবার খাওয়ার বদভ্যাসকে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অলোকেশ কোলে জানাচ্ছেন, এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, আউটডোরে যে সব টাইফয়েড রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে গত এক-দেড় মাস ধরে, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেককেই পরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে।

Dengue Fever : জ্বরের শুরুতেই টেস্টে ডেঙ্গি পজ়িটিভ অনেকে
কেননা, ওরাল অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অর্থাৎ, ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট টাইফয়েড। বাড়িতে ক্লোরামফেনিকল বা সিপ্রোফ্লক্সাসিন ট্যাবলেটে কাজ না-হওয়ায় বাধ্য হয়েই তখন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে ইন্ট্রাভেনাস সেফট্রিয়াক্সোন, এমনকী মেরোপেনমের মতো অ্যান্টিবায়োটিকও দিতে হচ্ছে। অলোকেশের কথায়, ‘পাঁচ দিন ওরাল অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে তখন ১৫ দিন ইন্ট্রাভেনাস অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মূলত অনলাইন ফুড ডেলিভারিতে মানুষ এত অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে যে, টাইফয়েডের নজির বেড়ে গিয়েছে।’

একই অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ রোহিত কাপুরও— ‘এমনিতে বর্ষায় টাইফয়েড বাড়ে। কিন্তু এবার যেন একটু বেশিই হচ্ছে। সবচেয়ে চিন্তার হলো, ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট আর বেয়াড়া ধরনের টাইফয়েড নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছে হাসপাতালে।’ তিনি জানান, সেই জটিল টাইফয়েডের জেরে কারও লিভারের বারোটা বাজছে তো কারও আবার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলছে সংক্রমণ।

Dengue Fever : ডেঙ্গির ময়দানে দাপট ‘নিরীহ’ ডেন-৩ স্ট্রেনের, প্রাণহানির আশঙ্কা কম-স্বস্তিতে স্বাস্থ্য দফতর
মুশকিল হলো, থার্ড জেনারেশন সেফালোস্পোরিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিকেও বাগে আসছে না অনেকের সংক্রমণ। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এমনিতে দিনসাতেক জ্বর থাকে টাইফয়েডে। সেই জ্বরে প্রথম পাঁচ দিন ধরে লাগাতার বাড়তে থাকে শরীরের তাপমাত্রা। ডাক্তারি পরিভাষায়, স্টেপ-ল্যাডার ফিভার। সঙ্গে থাকে দুর্বলতা, বমি ভাব ও সামান্য বা বেশি পেট ব্যথা, ডায়েরিয়া। সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকেই সেরে যায় সংক্রমণ। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, পাঁচ দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েও জ্বর কমছে না। কমছে না দুর্বলতা, কমে যাচ্ছে প্রস্রাব, অনেকের পেট ফুলে যাচ্ছে। কারও শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনিও হচ্ছে।

তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি না-করে তখন উপায় থাকছে না। চিকিৎসকরা তাই বলছেন, দেরি না করে জ্বরের তিন-চার দিনের মাথাতেই ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার সঙ্গে টাইফয়েড আইজিএম রক্তপরীক্ষাও করিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দিতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের একাংশের অন্ত্রে ‘অবস্ট্রাকশন’ ও ‘পারফোরেশন’ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

Dengue Symptoms : দেরিতে চিকিৎসা, ডেঙ্গির জেরে নষ্ট হল চোখ
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জয়দীপ ঘোষ বলছেন, ‘নিয়মিত টাইফয়েড রোগী পাচ্ছি হাসপাতালে। ওই সব রোগীদের বাড়িতে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে রোগ সারেনি বলেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত এক মাসে কমপক্ষে ১০-১২ জন এমন রোগী পেয়েছি যাদের ওরাল অ্যান্টিবায়োটিকে টাইফয়েড সারেনি।’ মেডিসিন তথা ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর সরকার জানাচ্ছেন, তাঁদের হাসপাতালে আউটডোরেই টাইফয়েডের ৮০% রোগীর ঠিকঠাক চিকিৎসা হয়ে যাচ্ছে।

২০% রোগীকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে ওরাল ওষুধে কাজ না-হওয়ার জন্য। তাঁর বক্তব্য, ‘মূলত ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট টাইফয়েড রোগীদেরই হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। তবে অন্য তেমন জটিলতা তাঁদের দেখছি না এখনও।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version